পছন্দের প্রতিষ্ঠানকে খেলাপি বিনিয়োগ প্রদান ও নিজের জামাতাকে ইসলামী ব্যাংকের সহযোগী প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) পদে নিয়োগ দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে ইসলামী ব্যাংকের স্বতন্ত্র পরিচালক এবং নির্বাহী কমিটির (ইসি) চেয়ারম্যান মো. আব্দুল জলিলের বিরুদ্ধে। এ কারণে তাঁকে চেয়ারম্যানের পদ থেকে সরিয়ে দিয়েছে পরিচালনা পর্ষদ। গত সোমবার অনুষ্ঠিত পর্ষদের সভায় এ সিদ্ধান্ত হয় বলে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে।
সূত্র জানায়, নতুন ঋণ বিতরণে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিষেধাজ্ঞা থাকার পরও গত ১০ ডিসেম্বর ইসলামী ব্যাংকের ইসি সভায় ‘ট্রু ফ্যাব্রিকস লিমিটেড’ নামে একটি প্রতিষ্ঠানের নামে ২৫০ কোটি টাকা বিনিয়োগ অনুমোদন করা হয়। প্রথমে প্রস্তাবিত ঋণের অঙ্ক ছিল ২২৫ কোটি টাকা। ঋণ অনুমোদনের দিন সকালে একপ্রকার তড়িঘড়ি করে ইসি চেয়ারম্যানের মৌখিক নির্দেশে সেই সীমা বৃদ্ধি করে ২৫০ কোটি টাকা করা হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরোর (সিআইবি) তথ্য অনুযায়ী, ‘ট্রু ফ্যাব্রিকস লিমিটেড’ নামের প্রতিষ্ঠানটি ঋণখেলাপি এবং তাদের কাছে ব্যাংকের ১৮ কোটি টাকা অনাদায়ি। এর পরের সভায় ঋণ অনুমোদন নিশ্চিত করে শাখাকে চিঠি দেওয়ার কথা থাকলেও সে পর্যন্ত অপেক্ষা করা হয়নি। অনুমোদনের পরদিনই তড়িঘড়ি করে ঋণ বিতরণ করা হয়।
মূলত ইসলামী ব্যাংকের অর্ধেক ঋণ বহুল আলোচিত এস আলম গ্রুপ নিয়ে গেছে। ব্যাংকটির এখন ঋণ দেওয়ার সক্ষমতা নেই। এমন পরিস্থিতিতে খেলাপি গ্রাহকের নামে নতুন ঋণ অনুমোদন করে ইসি সভা, যা নিয়ে রীতিমতো অবাক সংশ্লিষ্টরা।
জানা গেছে, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ইসলামী ব্যাংক পরিচালনায় যাঁদের স্বতন্ত্র পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়, তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন সাবেক ব্যাংকার আব্দুল জলিল। তাঁকে ইসি চেয়ারম্যান করা হয়। সেই সুযোগে অনিয়মে জড়িয়ে পড়েন আব্দুল জলিল। এমন পরিস্থিতিতে ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ গত সোমবার ইসি চেয়ারম্যানের পদ থেকে আব্দুল জলিলকে সরিয়ে দেয়। তাঁর পরিবর্তে স্বতন্ত্র পরিচালক মুহাম্মদ খুরশীদ ওয়াহাবকে ইসি চেয়ারম্যান করা হয়েছে। এর আগে তিনি ইসি কমিটির সদস্য ছিলেন।
অপর একটি সূত্র জানায়, আব্দুল জলিলের বিরুদ্ধে গত মাসে জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করে মশিউর রহমান নামে একজনকে ইসলামী ব্যাংক সিকিউরিটিজের এমডি করার অভিযোগ উঠেছে। মশিউর রহমান সম্পর্কে আব্দুল জলিলের জামাতা। আব্দুল জলিল ইসলামী ব্যাংক সিকিউরিটিজেরও চেয়ারম্যান।
অভিযোগের বিষয়ে মো. আব্দুল জলিল বলেন, নিজের পছন্দের প্রতিষ্ঠানকে ঋণ প্রদান ও জামাতাকে ইসলামী ব্যাংকের সহযোগী প্রতিষ্ঠানের এমডি করা হয়নি। ব্যাংকটির পুরোনো গ্রাহককে ঋণ দেওয়া হয়েছে। তাদের কারখানা চলমান রাখতে ঋণের প্রয়োজন ছিল। সে জন্য ব্যাংক ঋণ দিয়েছে। আমি কোনো প্রভাব খাটাইনি।’ আর জামাতাকে ইসলামী ব্যাংক সিকিউরিটিজের এমডি পদে নিয়োগ দেওয়ার অভিযোগও অস্বীকার করেন আব্দুল জলিল। তিনি বলেন, ‘আমার আত্মীয় হলেও তাঁকে আমি নিয়োগ দিইনি। তিনি ওই পদের জন্য যোগ্য বলে ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষই তাঁকে সেখানে বসিয়েছে।’
সূত্র আরও জানায়, আব্দুল জলিল একসময় ইসলামী ব্যাংক ও আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংকে চাকরি করতেন। এরপর তিনি ট্রু ফ্যাব্রিকস লিমিটেডে কাজ করেন।
গত ২২ আগস্ট ইসলামী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দিয়ে নতুন পর্ষদ গঠন করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। নতুন পর্ষদে রূপালী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদকে চেয়ারম্যান নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া স্বতন্ত্র পরিচালক হিসেবে নিয়োগ পান বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ খুরশীদ ওয়াহাব, আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংকের সাবেক ডিএমডি মো. আব্দুল জলিল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিপার্টমেন্ট অব ফাইন্যান্সের সাবেক অধ্যাপক ড. এম মাসুদ রহমান, চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট মো. আবদুস সালাম।
২০১৭ সালে ইসলামী ব্যাংকের মালিকানা পরিবর্তিত হওয়ার পর নামে-বেনামে বিপুল অঙ্কের টাকা বের করে নেয় এস আলম গ্রুপ। গত ১৮ নভেম্বর ইসলামী ব্যাংকের নতুন চেয়ারম্যান ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদ এক সংবাদ সম্মেলনে জানান, এস আলম ইসলামী ব্যাংকের ১৭টি শাখা থেকে ৮০ হাজার কোটি টাকা নিয়ে গেছে। শুধু টাকাই নেয়নি, আন্তর্জাতিক ব্যাংকগুলোর সঙ্গে ব্যাংকটির সম্পর্কও ধ্বংস করে দিয়েছে।