দরজায় কড়া নাড়ছে ‘বিশ্ব ভালোবাসা দিবস’। আর কয়েক ঘণ্টা। ভালোবাসার মানুষটির জন্য হৃদয়ের সবটা নিংড়ে একটা জুতসই বার্তা লিখতে হয়তো ব্যস্ত এখন অনেকে। অনেকের চোখের সামনেই হয়তো ভাসছে সেই মুহূর্তটি, যখন সে তার প্রিয় মানুষটিকে জানাবে তার ভালোবাসার কথা। ভালোবাসার বয়স নেই। তবু মূলত তরুণ-তরুণীরাই ভালোবাসার মানুষকে আকৃষ্ট করতে দিনটিকে বেছে নেয়। ভালোবাসার মানুষকে চমকে দিতে জোগাড় করে নানা উপহার। তা নিয়ে থাকে কত-না স্বপ্ন, কত-না ভাবনা। অনেকেই হয়তো প্রেমাষ্পদের জন্য সে উপহার কিনে ফেলেছেন। ভালোবাসা দিবস তো উৎসব এক। আর উৎসব তো উপহার ছাড়া হয় না। আর তাই দিনটিকে ঘিরে শুধু প্রেমিক-প্রেমিকা নয় হাসি ফোটে ব্যবসায়ীদের মুখেও।
বিশ্ব ভালোবাসা দিবস বা ভ্যালেন্টাইন ডে শুধু ভালোবাসার দেবতার রাজত্ব নয়; এটি একই সঙ্গে বাণিজ্যলক্ষ্মীরও। এটা শুধু এখানে নয়, গোটা বিশ্বেই এমন। প্রেম তো সব জড়িয়ে রাখে। ফলে বাণিজ্যের পরিসরও বিরাট। এখন তো আর শুধু ভ্যালেন্টাইন ডে নয়, আছে চকলেট ডে, প্রোপোজ ডে আরও কত কী। এই প্রতিটি দিনের জন্য আবার নির্ধারিত আছে নানা উপহার। মোটাদাগে উপহারের তালিকায় আছে ফুল, কেক, চকলেট, আংটি, রকমারি গ্যাজেট ইত্যাদি। আর উপহারের তালিকায় চির অমলিন পোশাক, জুয়েলারির মতো বিষয় তো আছেই। আছে বেড়াতে যাওয়া, খাওয়া, আড্ডা ইত্যাদি অনুষঙ্গ। ফলে হোটেল-রিসোর্ট, বিনোদনকেন্দ্র, রেস্তোরাঁর হিস্যাও জোরদার। সব মিলিয়ে এই দিবসকে কেন্দ্র করে লেনদেনের পরিমাণ কমপক্ষে কয়েক শ কোটি টাকা বললে অত্যুক্তি হবে না।
গত বছর করোনা পরিস্থিতির কারণে ব্যবসা তেমন না জমলেও এবারের চিত্র ভিন্ন। ক্ষতি পুষিয়ে নিতে বিভিন্ন লোভনীয় অফার দিয়ে ক্রেতাদের আকৃষ্ট করছেন ব্যবসায়ীরা। রেস্তোরাঁগুলোতে চলছে যুগলদের জন্য বিশেষ অফার। পোশাক, জুয়েলারির বিভিন্ন শোরুমে বিশ্ব ভালোবাসা দিবসের কেনাকাটায় চলছে বিশেষ ছাড়। ক্রেতারাও হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন। তবে জমজমাট ব্যবসার ভিড়েও কিছুটা শঙ্কা জাগিয়েছে করোনার নতুন ধরন ওমিক্রন। ওমিক্রনের শঙ্কা না থাকলে ব্যবসা আরও জমজমাট হতো বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
তবে একেবারে খারাপ হচ্ছে না। রিটেইল চেইনশপ ‘স্বপ্ন’-এর ওয়ারী শাখার অ্যাসিস্ট্যান্ট আউটলেট অপারেশন ম্যানেজার মোহাম্মদ রাকিব হোসেন রাজু আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘বিগত বছরের তুলনায় এ বছর বিক্রি বেশ ভালো। শুধু আমাদের এই শাখাতেই ভ্যালেন্টাইন ডের বিক্রি সাত-আট লাখ টাকা। স্বপ্নের দুই শতাধিক আউটলেট আছে। সব আউটলেট মিলে কোটি টাকার হিসাব। সঠিক অঙ্ক বলা মুশকিল। কারণ, একেক শাখায় বিক্রি একেক রকম।’
কী ধরনের পণ্য বিক্রি হচ্ছে সুপারশপগুলো থেকে? এর একটা জবাব পাওয়া যায় রাকিব হোসেনের কথায়। তিনি জানালেন, ‘ভ্যালেন্টাইন ডেতে মূলত চকলেট, কৃত্রিম ফুল, পুতুল, খেলনা, উপহারসামগ্রী, শো-পিসের বিক্রি বেড়েছে। বৈশ্বিক করোনা পরিস্থিতির কারণে অনেক পণ্যের চালান আটকে আছে। সেই পণ্যগুলো হয়তো ভ্যালেন্টাইন ডের পর ঢুকবে। সেগুলো সময়মতো পাওয়া গেলে বিক্রি আরও বাড়ত।’
আজকের পত্রিকার ঝিকরগাছা প্রতিনিধি মাসুদুর রহমান মাসুদ জানান, চাহিদা বেশি থাকায় ফুলের দামও বেড়েছে। ফলে করোনার কারণে গত বছরের লোকসান কিছুটা হলেও কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়েছেন কৃষকেরা। এবার বাজারে ১০০টি গোলাপ বিক্রি হয়েছে ১৫০০-১৬০০ টাকা দরে, যা আগে বিক্রি হতো ৩০০-৪০০ টাকায়। এবার রজনীগন্ধা একেকটি বিক্রি হয়েছে সাড়ে ১০-১২ টাকায়, যা আগে ছিল ৫-৬ টাকা। রঙিন গ্লাডিউলাস প্রতিটি মানভেদে বিক্রি হয়েছে ৬ থেকে ১৫ টাকায়, যা আগে ছিল ৪-৬ টাকা। জারবেরা বিক্রি হয়েছে ১০-১২ টাকায়, যার আগে ছিল ৬-৮ টাকা। ফুল বাঁধাইয়ের জন্য কামিনীর পাতা বিক্রি হয়েছে প্রতি আঁটি ১০০ টাকায়, যা আগে বিক্রি হতো ৪০-৫০ টাকায়। জিপসির আঁটি বিক্রি হয়েছে ৮০-১০০ টাকায়। যা আগে ছিল ২০-২৫ টাকায়। গাঁদা ফুল বিক্রি হয়েছে প্রতি হাজার ৬০০-৮০০ টাকায়, যা আগে ছিল ২০০-৩০০ টাকা। লিলিয়াম প্রতি পিস বিক্রি হয়েছে ১৫০ টাকা। চন্দ্রমল্লিকা ৩০০ টাকা, যা আগে বিক্রি হতো ১০০ টাকায়। রকস্টিকের আঁটি বিক্রি হয়েছে ১০০ টাকায়, আগে বিক্রি হতো ৫০ টাকায়।
বাংলাদেশ ফ্লাওয়ার সোসাইটির সভাপতি আব্দুর রহিম বলেন, করোনাভাইরাস, লকডাউন, আম্ফান ঘূর্ণিঝড় ও অসময়ে বৃষ্টিতে ফুলচাষিরা ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। বসন্তবরণ ও বিশ্ব ভালোবাসা দিবস উপলক্ষে পাঁচ দিনে প্রায় ১০ কোটি টাকার ফুল বিক্রি হওয়ায় চাষিদের মুখে এবার হাসি ফুটেছে।
তবে এই কেকের বাজার ঠিক কত বড়, সে সম্পর্কে সঠিক পরিসংখ্যান হাতে নেই। একই অবস্থা চকলেটের ক্ষেত্রেও। চকলেটকে বলা যেতে পারে ম্যান্ডেটরি গিফট। সব বয়সী মানুষই এই উপহার পছন্দ করেন। কিন্তু ভালোবাসা দিবসকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে এই বাজার ঠিক কতটা বড়, সে সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই। দেশে চকলেটের চাহিদার একটি বড় অংশই মেটে আমদানি থেকে। এখানেও রয়েছে জটিলতা। অনেকে শুল্ক ফাঁকি দিতে ব্যক্তিগতভাবে লাগেজে করে চকলেট পরিবহন করেন। ফলে একটি দিবসকে কেন্দ্র করে এর বাজারের পরিসর সম্পর্কে ধারণা পাওয়া আসলেই দুরুহ।
কলিম উল্লাহ আরও বলেন, ‘এবার বেশ ভালো সাড়া পাচ্ছি। এটা বেশ আশা জাগানিয়া বিষয়। মানুষের উৎসাহ-উদ্দীপনা আমাদের অণুপ্রেরণা জোগাচ্ছে। ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার আশা রাখছি। বিশ্ব ভালোবাসা দিবসকে কেন্দ্র করে কমপক্ষে ১০ কোটি টাকার লেনদেন হবে।’
এ ছাড়া জুয়েলারি, মোবাইল সেটসহ নানা ডিভাইস এখন ভালোবাসা দিবসের উপহারের তালিকায় ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। জুয়েলারি, ডিভাইস ইত্যাদি উপহারের বিষয়টি সামর্থ্যের ওপর অনেকাংশেই নির্ভরশীল। এই সামর্থ্যের পরিসরও কিন্তু বাড়ছে। ফলে বাড়ছে ভালোবাসা দিবসকেন্দ্রিক ব্যবসার পরিসর। বাংলাদেশে এই উপহারের বাজারের আকার এখন কত বড়, তার ঠিকঠাক পরিসংখ্যান পাওয়া যায় না। তবে অনুমান করা যায় ঠিকই। শুধু ফুল ও পর্যটন খাত মিলিয়েই কিন্তু বাজারটির আকার ২০ কোটি ছাড়িয়ে গেল। এর সঙ্গে চকলেট, জুয়েলারি, পুতুল, রকমারি ডিভাইস, অনলাইন কেনাকাটার গিফট কুপন ইত্যাদি যোগ করে নিলে এটি শত কোটি টাকা অনায়াসে ছাড়িয়ে যাবে বলে ধারণা করা যায়।
একটু বিদেশ ঘুরে এলেই ব্যাপারটি কিছুটা বোঝা যাবে। স্ট্যাটিস্টা ডটকমের তথ্যমতে, ২০২২ সালে যুক্তরাষ্ট্রে ভালোবাসা দিবস ঘিরে ২ হাজার ৩৯০ কোটি ডলারের ব্যবসা হয়েছে। ২০২১ সালে এর পরিমাণ ছিল ২ হাজার ১৮০ কোটি ডলার। আর ২০২০ সালে ছিল ২ হাজার ৭৪০ কোটি ডলার। ২০২১ সালে অস্ট্রেলিয়ায় এ দিবসকে কেন্দ্র করে শুধু উপহারসামগ্রীর ব্যবসার আকার ছিল ৩৭ কোটি ৭০ লাখ ডলারের। নিউজিল্যান্ডে এর পরিমাণ ছিল ২১ কোটি ৬০ লাখ ডলারের।
পাশের দেশ ভারতে এর আকারটি কেমন? করোনা পরিস্থিতির মধ্যেও দেশটিতে ভ্যালেন্টাইন ডে ঘিরে মাথাপিছু ব্যয়ে বেড়েছে। এ বছরের হিসাব পাওয়া না গেলেও গেল বছর গড়ে প্রতিজন তাদের প্রিয়জনকে উপহার দিতে ১৩০ ডলারের বেশি ব্যয় করেছেন। নিশ্চিতভাবেই আগের তুলনায় দেশটিতে এ বাবদ মানুষের বাজেট বেড়েছে। আগে কেমন ছিল। ইকোনমিক টাইমস অব ইন্ডিয়া জানাচ্ছে, ২০০৭ সালে ভালোবাসা দিবসে ১ হাজার ২০০ কোটি রুপির বেশি ব্যবসা হয়েছিল। তাহলে বর্তমানের ব্যবসার পরিসরটি সহজেই বোঝা যাচ্ছে। আর বাংলাদেশ? সঠিক পরিসংখ্যান হাতে না থাকলেও ব্যবসার আকারটি যে চোখ কপালে তুলে দেওয়ার মতো, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।