মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে চলমান সংঘাতের কারণে টেকনাফ স্থলবন্দরের আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম প্রায় স্থবির হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে আরাকান আর্মি মংডু শহরসহ প্রায় ২৭০ কিলোমিটার এলাকা দখল করার পর মিয়ানমার থেকে পণ্যবাহী ট্রলারগুলো টেকনাফ বন্দরে পৌঁছাতে পারছে না। গত ৮ ডিসেম্বর মংডু শহর আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে যাওয়ার পর থেকে আমদানি কার্যক্রম প্রায় বন্ধ রয়েছে। এতে দাম পরিশোধ করেও অনেক ব্যবসায়ী পণ্য দেশে আনতে পারছেন না। ফলে ব্যবসায়িক ক্ষতির পাশাপাশি সরকারের রাজস্ব আয়েও নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। ২০২৩ সালের ১৩ নভেম্বর মিয়ানমারের জান্তা বাহিনী ও বিদ্রোহী আরাকান আর্মির মধ্যে সংঘাত শুরু হয়।
কাস্টমস কর্তৃপক্ষের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) টেকনাফ স্থলবন্দর থেকে রাজস্ব আদায় হয়েছে মাত্র ৬৪ কোটি ১৯ লাখ টাকা; অথচ ২০২৩-২৪ অর্থবছরের একই সময়ে এই আয় ছিল প্রায় ২৫১ কোটি টাকা। প্রতিদিন গড়ে যেখানে ৩ কোটি টাকার বেশি রাজস্ব আদায় হতো, বর্তমানে তা উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে।
মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে সাধারণত বিভিন্ন ধরনের কাঠ, হিমায়িত মাছ, শুকনা সুপারি, আদা, শুঁটকি, নারকেল, আচার প্রভৃতি পণ্য আমদানি করা হয়। আর বাংলাদেশ থেকে মিয়ানমারে যায় আলু, প্লাস্টিক পণ্য, তৈরি পোশাক, বিস্কুট, চানাচুর, চিপস ও কোমল পানীয়।
টেকনাফ স্থলবন্দর সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক এহতেশামুল হক বাহাদুর বলেন, ২০২৩ সালের নভেম্বর থেকে দুই দেশের মধ্যে পণ্যবাহী ট্রলার ও জাহাজ চলাচল প্রায় বন্ধ রয়েছে। ফলে বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি কার্যক্রম পুরোপুরি থেমে আছে। মিয়ানমারের মংডু বন্দরের সঙ্গে আমদানি ও রপ্তানি—দুটিই বন্ধ। তবে মাঝেমধ্যে আকিয়াব ও ইয়াঙ্গুন থেকে থেমে থেমে পণ্য আমদানি হচ্ছে অল্প পরিসরে। এতে ব্যবসায়ীরা কঠিন সংকটে পড়েছেন।
টেকনাফ স্থলবন্দর সূত্র জানায়, ২০২২-২৩ অর্থবছরে টেকনাফ স্থলবন্দর দিয়ে ২ লাখ ২ হাজার ৭৪২ টন পণ্য হ্যান্ডলিং হয়েছিল। এর মধ্যে আমদানি পণ্য ছিল ১ লাখ ৯৯ হাজার ২১৯ টন এবং রপ্তানি পণ্য মাত্র ৩ হাজার ৫২৩ টন। পরবর্তী ২০২৩-২৪ অর্থবছরে হ্যান্ডলিং নেমে আসে ৭৯ হাজার ৬৬৬ টনে। এর মধ্যে আমদানি হয় ৭৮ হাজার ৫৫৭ টন এবং রপ্তানি ১ হাজার ৪০৯ টন। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত আমদানি-রপ্তানির পরিমাণ আরও কমেছে। অর্থবছরের জুলাই, আগস্ট, অক্টোবর ও নভেম্বর মাসে কোনো পণ্য রপ্তানি হয়নি। জুলাই মাসে আমদানি হয় ১২ হাজার ৫২৯ টন, আগস্টে ২ হাজার ২৭৩, সেপ্টেম্বরে ১ হাজার ৬৪৭, অক্টোবরে ১ হাজার ১৬৬, নভেম্বরে ২ হাজার ২৯৬ টন এবং ডিসেম্বরে আমদানি হয় ৩ হাজার ৭২৪ টন ও রপ্তানি হয় মাত্র ৬৩৭ টন পণ্য।
জানা গেছে, ১৯৯৫ সালে সীমান্ত বাণিজ্য চালু হলেও এখনো আমদানি-রপ্তানিতে ঋণপত্র বা এলসি প্রথা চালু হয়নি। মূলত ফরেন ডিমান্ড ড্রাফটের (এফডিডি) মাধ্যমে সীমান্ত বাণিজ্য চলছে। ডলারের মূল্যবৃদ্ধি ও সংকট দেখা দেওয়ায় স্থানীয় ব্যবসায়ীরা এফডিডির সংকটে পড়েন। এর মধ্যে প্রতিবেশী দেশটিতে যুদ্ধের কারণে দেশের ব্যবসায়ীরা নতুন করে সংকটে পড়েছেন।
কাস্টমসের তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জুলাইয়ে টেকনাফ স্থলবন্দর থেকে রাজস্ব আদায় হয়েছে প্রায় ৭ কোটি টাকা। এ ছাড়া আগস্টে প্রায় ২৫ কোটি, সেপ্টেম্বরে সোয়া ৯ কোটি, অক্টোবরে প্রায় ৭ কোটি ও নভেম্বরে সোয়া ১৬ কোটি টাকার রাজস্ব আদায় করা হয়েছে। গত অর্থবছরের জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত পাঁচ মাসে রাজস্ব আদায় হয়েছিল যথাক্রমে প্রায় ৪০, ৪৯, ৪৮, ৬৬ ও ৪৮ কোটি টাকা।
টেকনাফ স্থলবন্দর পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান ইউনাইটেড ল্যান্ড পোর্টের ব্যবস্থাপক এ এইচ এম আনোয়ার হোসেন বলেন, আগে মিয়ানমার থেকে প্রতিদিন ৩০ থেকে ৩৫টি পণ্যবাহী কার্গো ট্রলার ও জাহাজ বাংলাদেশে আসত। সেই সংখ্যা কমে এখন সপ্তাহে এক থেকে দুটিতে নেমেছে। একইভাবে আগে বাংলাদেশ থেকে প্রতিদিন ৮ থেকে ১০টি কার্গো ট্রলারে মিয়ানমারে পণ্য যেত। সেখানে ১০ মাস ধরে পণ্যবাহী কোনো ট্রলার মিয়ানমারে যাচ্ছে না।
টেকনাফ স্থলবন্দরের কাস্টমস কর্মকর্তা বি এম আবদুল্লাহ আল মাসুম বলেন, মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সংঘাতের কারণে টেকনাফ বন্দরের কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়েছে। এতে রাজস্ব আয়ে বড় ধস নেমেছে। দ্রুত এ সমস্যার সমাধান প্রয়োজন।