বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজ (বিসিআই) জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কাছে ১৫ শতাংশ একক হারভুক্ত মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট বাস্তবায়নের প্রস্তাব করেছে। সংগঠনটি একই সঙ্গে ব্যক্তিগত করমুক্ত আয়সীমা পাঁচ লাখ টাকা নির্ধারণ, প্রাইভেট কোম্পানির জন্য শর্তহীন ২৫ শতাংশ করপোরেট কর এবং শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির জন্য ২০ শতাংশ করপোরেট কর নির্ধারণের সুপারিশ করেছে।
বিসিআইয়ের মতে, এই প্রস্তাব বাস্তবায়িত হলে ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি হবে এবং দেশের ক্ষুদ্র ও মাঝারি খাতের পক্ষে এটি অত্যন্ত উপযোগী হবে। এতে রাজস্ব আহরণের প্রক্রিয়া সহজ ও কার্যকর হবে, যা দেশের সার্বিক অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে এনবিআর ভবনে আয়োজিত ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রাক্-বাজেট আলোচনায় সংগঠনটির এসব প্রস্তাব তুলে ধরেন বিসিআই সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী পারভেজ। এনবিআর চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন।
ভ্যাটের একক হার নির্ধারণের প্রস্তাব
বিসিআইয়ের পক্ষ থেকে জানানো হয়, দেশের ৮৫ শতাংশ ব্যবসা ক্ষুদ্র ও মাঝারি খাতের, যারা ভোক্তাবান্ধব পরিবেশের জন্য কার্যকর হারের আওতায় আসতে চায়। আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী পারভেজ বলেন, একক ১৫ শতাংশ ভ্যাট ব্যবস্থা কার্যকর হলে দেশে ব্যবসাবান্ধব, ভোক্তাবান্ধব এবং রাজস্ববান্ধব পরিবেশ তৈরি হবে। এটি দেশের অর্থনীতির জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ও উপকারী।
আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী বলেন, সারা দেশের মোট স্থানীয় ভ্যাটের বড় অংশ আহরিত হয় প্রায় ৫০০টি বড় প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। এই প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সিগারেট, মোবাইল ফোন, গ্যাস, বিদ্যুৎ, ব্যাংকিং, ওষুধ, পেট্রোলিয়াম, সিমেন্ট, সিরামিক, টাইলস এবং বেভারেজ ইত্যাদি খাত অন্তর্ভুক্ত। তাই এসব খাতকে মনিটরিং করলে ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসার ওপর থেকে করভার যথাযথভাবে ভাগ করা সম্ভব হবে এবং এতে রাজস্ব আহরণের কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না।
প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ করের অনুপাত পরিবর্তনের সুপারিশ
বিসিআই আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ করেছে, তা হলো দেশে প্রত্যক্ষ কর ও পরোক্ষ করের অনুপাত ৩৫:৬৫ থেকে দ্রুত পরিবর্তন করে ৬৫:৩৫ হারে নিয়ে আসা উচিত। আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী পারভেজ জানান, সুষম কর ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করা হলে তা দেশের উৎপাদনশীলতা বাড়াতে সহায়ক হবে এবং ভোক্তার স্বার্থও সংরক্ষিত থাকবে।
করপোরেট কর কমানোর প্রস্তাব
বিসিআই জানায়, দেশের করপোরেট করহার প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় অনেক বেশি। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার জন্য প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানির জন্য করপোরেট কর ২৫ শতাংশ এবং পাবলিক ট্রেডেড কোম্পানির জন্য ২০ শতাংশ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। বিসিআইয়ের মতে, এই কম হার ব্যবসায়ীদের জন্য উৎসাহজনক হবে এবং স্থানীয় ব্যবসার পরিবেশে উন্নতি ঘটাবে।
ব্যক্তিগত করমুক্ত সীমা পুনর্নির্ধারণের দাবি
বিসিআইয়ের পক্ষ থেকে ব্যক্তিগত করমুক্ত আয়সীমা ৫ লাখ টাকায় উন্নীত করার প্রস্তাবও করা হয়েছে, যা ভারতের ১২ লাখ রুপি আয়কর সীমার তুলনায় অনেক কম। বিসিআইয়ের সভাপতি পারভেজ বলেন, বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এবং জীবনযাত্রার ব্যয় বিবেচনায় এই সীমা পুনর্নির্ধারণ করা উচিত।
এনবিআর চেয়ারম্যানের প্রতিক্রিয়া
এনবিআর চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান প্রস্তাবিত করছাড় নিয়ে মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, কর অব্যাহতি দিলে এর অপব্যবহার হয় এবং দীর্ঘ মেয়াদে কর ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়ে। সুতরাং, দেশের কর ব্যবস্থা শক্তিশালী করার জন্য সঠিক সময়ের মধ্যে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, ‘যেসব দেশে কর-জিডিপি অনুপাত বাংলাদেশের চেয়ে বেশি, তাদের তুলনায় আমাদের দেশের পরিস্থিতি আলাদা। তবে আমাদের এখনো কর পদ্ধতিতে অনেক কিছু উন্নতি করার সুযোগ রয়েছে।’
পেপারশিল্পের পরিস্থিতি
পেপার মিল অ্যাসোসিয়েশনের মোস্তাফিজুর রহমান পেপারশিল্পের বর্তমান পরিস্থিতি তুলে ধরেন। তিনি জানান, এ খাতে এক লাখ কোটি টাকার বিনিয়োগ এবং ১০ লাখের বেশি কর্মসংস্থান সৃষ্টি হলেও কিছু সমস্যার কারণে শিল্পটি পিছিয়ে পড়েছে। তিনি বলেন, পেপার মিলের জন্য বিনা শুল্কে কাগজ আমদানি করার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল, তবে বাজারে কাগজ সরবরাহে অনিয়ম দেখা দিয়েছে, যা পেপার মিলের জন্য ক্ষতিকর। এনবিআর চেয়ারম্যান এই বিষয়ে মন্তব্য করেন, সিস্টেমে কিছু অস্বাভাবিকতা থাকতে পারে, তবে দ্রুত এর সমাধান করা হবে।