ভোজ্যতেলের দাম যাতে না বাড়ে, সে জন্য আমদানি পর্যায়ে ৫ শতাংশ ভ্যাট ছাড় দিয়েছিল সরকার। ব্যবসায়ীরাও দাম না বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু কথা রাখেননি তাঁরা। ঘোষণা দিয়ে দাম না বাড়ালেও বাজারে খোলা তেলের সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছেন তাঁরা। এতে বেড়েছে দামও। এক মাসে সয়াবিনের লিটারে বেড়েছে ২০ টাকা। এ অবস্থায় আরও ৫ শতাংশ ভ্যাট ছাড়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
দেশে ভোগ্যপণ্যের সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে ভোজ্যতেলের রেকর্ড দাম বেড়েছে। খোলা তেলের দাম মণপ্রতি বেড়েছে ১ হাজার ৩০০ টাকা পর্যন্ত। আর কেজিতে বাড়ে ২১-৩৫ টাকা পর্যন্ত। চাক্তাই- খাতুনগঞ্জ আড়তদার সাধারণ ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. মহিউদ্দীন জানান, ভোজ্যতেলের আন্তর্জাতিক বাজার চড়া। খাতুনগঞ্জের বাজারে সরবরাহ সংকটও রয়েছে। চাহিদা অনুযায়ী এলসিও করা যাচ্ছে না বিভিন্ন জটিলতার কারণে। ফলে দাম বাড়তি।
তবে মিলমালিকদের দাবি, তাঁদের সরবরাহ আগের মতোই স্বাভাবিক রয়েছে। দামও বাড়ানো হয়নি। তাঁরা বলছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধির প্রবণতা থাকলে অনেক সময় মধ্যস্বত্বভোগীরা বাড়তি মুনাফার আশায় তেল মজুত করে রাখে। এ ছাড়া পাচারের আশঙ্কাও থাকে। দেশে ভোজ্যতেলে বাজার নিয়ন্ত্রণ করে টিকে গ্রুপ, সিটি গ্রুপ, এস আলম গ্রুপ, মেঘনা গ্রুপ, বসুন্ধরা মাল্টি ফুড প্রোডাক্টস, স্মাইল ফুড প্রোডাক্টস, সেনা এডিবল অয়েল ইন্ডাস্ট্রিজ, ডেলটা অ্যাগ্রো ফুড ইন্ডাস্ট্রিজ, আবুল খায়েরসহ ১১-১২টি ব্র্যান্ড কোম্পানি। তবে এর মধ্যে সরাসরি আমদানি করে ৪-৫টি কোম্পানি।
দেশে ভোজ্যতেলের অন্যতম বড় আমদানি ও সরবরাহকারী কোম্পানি টিকে গ্রুপের পরিচালক (ব্র্যান্ড) শফিউল আতাহার তসলিম আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমাদের মিল পর্যায়ে তেলের সরবরাহ ঘাটতি বা মূল্যবৃদ্ধি কিছুই হয়নি। ভোজ্যতেলের সরবরাহ সংকটের কথা আজ (গতকাল) মন্ত্রণালয়ের বৈঠকের সময় আমাদের জানানো হয়েছে। সেখানে আমরা আমাদের সরবরাহের কাগজপত্র দেখিয়েছি।’
শফিউল আতাহার তসলিম বলেন, ‘যখন কোনো পণ্যের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে অনেক বেড়ে যায় কিন্তু দেশের বাজারে তা সমন্বয় করা হয় না, তখন একশ্রেণির মধ্যস্বত্বভোগী এর সুযোগ নিতে চায়। তারা পণ্য মজুত করে রাখে, কারণ, তারা জানে এই পণ্যের দাম শিগগির বাড়বে। তেলের ক্ষেত্রেও এমনটা হতে পারে। তাই আমাদের পরামর্শ হলো, প্রতি মাসে বৈঠক করে আন্তর্জাতিক বাজারে বাড়লে দেশে বাড়ানো হোক আর কমলে কমানো হোক। তাহলে বাজারে সরবরাহ ঠিক থাকবে।’
এদিকে পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতার অভিযোগ, দাম বাড়াতে রিফাইনারিগুলো একযোগে সরবরাহ কমিয়েছে। চাহিদামতো তেল সরবরাহ পাচ্ছেন না তাঁরা। অনেক ডিলার ১০-১১ দিন ঘুরে তেলের সরবরাহ পাচ্ছেন না বলে জানিয়েছেন।
রাজধানীর শান্তিনগর এলাকার একটি ব্র্যান্ড কোম্পানির ডিলার জিয়াউদ্দীন আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘চাইলেই এখন তেলের ডিও (ডেলিভারি অর্ডার) কাটা যাচ্ছে না। চাহিদামতো তেলের সরবরাহও পাওয়া যাচ্ছে না। কোম্পানি অ্যাকাউন্টে টাকা জমা দিয়ে রাখলে কোম্পানিগুলো তাদের সময়মতো যখন খুশি পণ্য ডেলিভারি দিচ্ছে। সেটা কখনো ১০-১১ দিন পর। আমি সর্বশেষ গতকাল ১ ও ২ লিটারের তেলের বোতল সরবরাহ পেয়েছি। তার আগে পেয়েছিলাম ৩ নভেম্বর। গত এক মাস যাবৎ এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।’
এ ছাড়া কোম্পানিগুলো তেলের দামও বাড়িয়েছে বলে জানান এই সরবরাহকারী। তিনি বলেন, ‘বোতলজাত ৫ লিটারের খুচরা মূল্য (গায়ের মূল্য) ৮১৮ টাকা, আর খুচরা বিক্রেতা মূল্য ৮০৩ টাকা। কিন্তু আগে আমরা খুচরা বিক্রেতার কাছে ৭৯০ টাকাতেও সরবরাহ করতে পারতাম। কিন্তু কোম্পানিগুলো দাম বাড়ানোর কারণে এখন পারছি না।’
একই রকম কথা বলেন আরেকটা কোম্পানির পল্টন এলাকার ডিলার মেহেদি হাসান রাজিব। তিনি বলেন, প্রায় সব কোম্পানির একই অবস্থা। তেলের সরবরাহ অনেক কমে গেছে। চাহিদামতো তেল পাওয়া যাচ্ছে না ব্র্যান্ড কোম্পানি থেকে।
ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য বলছে, তেলের দাম না বাড়ানোর জন্য ভ্যাট ছাড় দেওয়ার পর থেকে গত এক মাসে খুচরায় খোলা সয়াবিন তেলের দাম বেড়েছে প্রতি লিটারে ২০ টাকা। এর মধ্যে গত এক সপ্তাহে বেড়েছে ৭ টাকা। এক মাসে এত মূল্যবৃদ্ধি এর আগে কখনো হয়নি বলে অনেক ব্যবসায়ী বলেছেন। বর্তমানে প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন তেল বিক্রি হচ্ছে ১৭০-১৭২ টাকা লিটার, যা এক সপ্তাহ আগে ছিল ১৬৩-১৬৫ টাকা। টিসিবির হিসাবেই মাসখানেক আগে এক লিটার সয়াবিন তেল কেনা যেত ১৫২-১৫৬ টাকায়। এ ছাড়া খোলা পাম সুপার এখন ১৬৪-১৬৫ টাকা লিটার বিক্রি হচ্ছে, যা এক সপ্তাহ আগে ছিল ১৫৪-১৫৬ টাকা। আর এক মাস আগে পাম সুপার বিক্রি হয়েছিল ১৪৭-১৫০ টাকা লিটার। সে হিসাবে ভ্যাট ছাড় দেওয়ার পর এক মাসে এই তেলের দাম বেড়েছে প্রতি লিটারে ১৭ টাকা।
রাজধানীর পাইকারি মৌলভীবাজারের ব্যবসায়ীরা বলছেন, চাইলেই চাহিদামতো তেল পাওয়া যাচ্ছে না। কেউ কেউ ৩ দিনে এক দিন, কেউ এক সপ্তাহে এক দিন তেলের এসও পাচ্ছে। এ ছাড়া দামও অনেক বেশি রাখে কোম্পানিগুলো।
মৌলভীবাজারের পাইকারি ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, মিলগেট থেকে তাঁরা বুধবার পর্যন্ত প্রতি মণ সয়াবিন তেল (১৬৭.১১ লিটার) ৬৯০০ টাকায় কিনছেন। আর পাম তেল বিক্রি হয়েছে ৬৫০০-৬৬০০ টাকা মণ। তবে গতকাল প্রতি মণ তেলের দাম ১৫০ টাকা পর্যন্ত কমেছে।
মৌলভীবাজার পাইকারি ভোজ্যতেল ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবুল হাশেম আজকের পত্রিকাকে বলেন, কোম্পানিগুলো যখন দাম বাড়ানোর পরিকল্পনা করে, তখন সরবরাহ কমিয়ে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে। এবারও তা-ই হয়েছে। তারা সরবরাহ কমিয়ে দাম আস্তে আস্তে দাম বাড়াচ্ছে।
সেগুনবাগিচা বাজারের মুদিদোকানি মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘আমি গত এক সপ্তাহ পর আজ বসুন্ধরার তেলের সরবরাহ পেয়েছি। পরিচিত কাস্টমারদের চাহিদামতো তেলের সরবরাহ দিতে পারছি না, এটা খুবই বিব্রতকর। এ ছাড়া মুনাফাও কমিয়ে দিয়েছেন সরবরাহকারীরা। ৫ লিটার তেল বিক্রি করলে ৮-১০ টাকা মুনাফা থাকছে। ৮০০ টাকায় যদি ১০ টাকা মুনাফা হয়, তবে ব্যবসা করা কষ্টকর ব্যাপার আমাদের মতো খুচরা বিক্রেতাদের।’
ভোজ্যতেলে সর্বশেষ গত ১৮ এপ্রিল নির্ধারণ করা দাম অনুসারে খোলা সয়াবিন তেলের সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য ১৪৭ টাকা লিটার ও বোতলজাত সয়াবিন তেল ১৬৭ টাকা লিটার। এ ছাড়া সয়াবিন তেলের পাঁচ লিটারের বোতল ৮০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ওই সময় ৮১৮ টাকা নির্ধারণ করা হয়। পাম সুপার প্রতি লিটার সর্বোচ্চ ১৩৫ টাকা।
সে হিসাবে ব্যবসায়ীরা খোলা সয়াবিন তেলের দাম বাড়তি রাখছেন লিটারে ২৩ টাকা ও পাম সুপারে বাড়তি রাখছেন ২৯ টাকা। তবে মিলমালিকেরা বলছেন, তেলের সরবরাহ তাঁরা স্বাভাবিক রেখেছেন। একই সঙ্গে দামও বাড়ানো হয়নি।
এ বিষয়ে গতকালও মিলমালিকদের সঙ্গে বৈঠক করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। সেখানে তাঁরা আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে প্রতি মাসে দাম সমন্বয়ের দাবি করেন। তবে শেষ পর্যন্ত ব্যবসায়ীরা দাম বাড়াবেন না এমন শর্তে আমদানি পর্যায়ে আরও ৫ শতাংশ ভ্যাট ছাড়ের প্রস্তাব দেন বাণিজ্য উপদেষ্টা। মিলমালিকেরাও এ প্রস্তাব মেনে নেন।