নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণা
নীতি সুদহার বিদ্যমান ১০ শতাংশে অপরিবর্তিত রেখে নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের (জানুয়ারি-জুন) জন্য প্রণীত এই মুদ্রানীতিতে মূল্যস্ফীতি ৭ শতাংশে নামানোর লক্ষ্য ধরা হয়েছে। তবে বাজারে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণসহ সামগ্রিক পদক্ষেপ না নিয়ে শুধু সুদহারকে হাতিয়ার করে মূল্যস্ফীতি কমানো যাবে না বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদেরা।
সোমবার বাংলাদেশ ব্যাংকের জাহাঙ্গীর আলম কনফারেন্স হলে নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণা করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘২০২৪ ও ২০২৫ সাল বিনিয়োগ বৃদ্ধির বছর নয়। বিনিয়োগ বৃদ্ধির আশা তো দূরের কথা, স্বপ্নও দেখি না। এখন আমাদের প্রধান টার্গেট মূল্যস্ফীতি কমানো। আশা করছি, আগামী জুন মাসের মধ্যে দেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতি ৭ থেকে ৮ শতাংশের মধ্যে নেমে আসবে। তখন ধীরে ধীরে নীতি সুদহার কমানো হবে।’
দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘চাইলেই বাংলাদেশ ব্যাংক সব করতে পারবে না। তাই সময় লাগছে। যেকোনো সিদ্ধান্তের ফল আসতে ছয় থেকে ১২ মাস পর্যন্ত সময় লাগে। আর কাঙ্ক্ষিত ফল পাওয়ার জন্য ১৮ থেকে ২৪ মাস সময় প্রয়োজন হয়। আমরা আশা করছি, আগামী জুনের মধ্যে ৭ থেকে ৮ শতাংশ ও ২০২৬ সালে দেশের মূল্যস্ফীতি ৫ শতাংশে নেমে আসবে।’
নীতি সুদহার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি কমানোর কৌশল ব্যর্থ হওয়ার পর সমালোচনার মুখে সেই নীতি থেকে সরে এল বাংলাদেশ ব্যাংক। দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি ভোগাচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে। একাধিকবার সুদহার বাড়িয়েও তা নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি।
মূল্যস্ফীতি বাড়তে থাকলে গত ২৫ আগস্ট নীতি সুদহার ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ৯ শতাংশে উন্নীত করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এরপর ২৪ সেপ্টেম্বর আরেক দফা বাড়িয়ে ৯ দশমিক ৫ শতাংশে উন্নীত করা হয়। এরপর ২২ অক্টোবর আরো ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ১০ শতাংশে উন্নীত করা হয়।
এর আগে ২০২২ সালের মে মাসে নীতি সুদহার ছিল ৫ শতাংশ। সেটা বাড়তে বাড়তে আড়াই বছরে দ্বিগুণ অর্থাৎ ১০ শতাংশ হয়েছে। কিন্তু মূল্যস্ফীতির পাগলা ঘোড়া থামেনি। সরকার পতনের পর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি হয়। এর মধ্যে বাজার নিয়ন্ত্রণে তেমন কোনো কার্যকর ভূমিকা নেয়নি সরকার।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, জানুয়ারি মাসে সাধারণ মূল্যস্ফীতি কমে ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশে নামে, যা ডিসেম্বরে ছিল ১০ দশমিক ৮৯ শতাংশ। কয়েক মাসের মধ্যে এই প্রথম মূল্যস্ফীতি এক দুই অঙ্কের নিচে নামল। এর আগে সবশেষ গত বছরের জুনে মূল্যস্ফীতির হার এর নিচে অর্থাৎ ৯ দশমিক ৭২ শতাংশ ছিল। জুলাই মাসে তা একলাফে তা একলাফে বেড়ে ১১ দশমিক ৬৬ শতাংশে উঠে। নভেম্বরে তা কমে ১১ দশমিক ৩৩ শতাংশ এবং সর্বশেষ ডিসেম্বরে আরো কমে ১০ দশমিক ৮৯ শতাংশে নেমে আসে।
গত বছরের জুলাই মাস ছিল আন্দেলনের মাস, কোটা সংস্কারের দাবিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মসূচির মধ্যে মাসজুড়ে অস্থিরতার কারণে পণ্য সরবরাহ ব্যাপকভাবে বাধাগ্রস্ত হয়। জিনিসপত্রের দাম আকাশচুম্বী হয়, পরে কিছুটা কমলেও উচ্চ মূল্যস্ফীতির ধারা অব্যাহত থাকে। পাঁচ মাসের ব্যবধানে শীত মৌসুমে মূল্যস্ফীতির পারদ নিচের দিকে নামল।
তবে এতে সুদহার বাড়ানোর কোনো কৃতিত্ব নেই বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদেরা। তাঁরা বলছেন, শীত মৌসুমে বাজারে নতুন শাক-সবজির সরবরাহের ফলে বাজারে খাদ্যপণ্যের দাম কমেছে। এর ফলে তা সার্বিক মূল্যস্ফীতিতে স্বস্তি এনে দিয়েছে।
গবেষণা পরিচালক পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) পরিচালক ড. এম এ রাজ্জাক বলেন, শুধু সুদহার কমলেই মূল্যস্ফীতি কমানো যাবে না। সব দিক বিবেচনায় নিতে হবে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সুদের বাড়ানো হলে বা কমানো হলে কী ঘটতে পারে, সে বিষয়ে বাস্তবসম্মত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সুদ বাড়ানো হলে ব্যবসায় নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। আবার মূল্যস্ফীতিও নিয়ন্ত্রণ করা দরকার।