পানশালাটির নাম ‘ক্লাব ২১৯’। সমকামীদের এই পানশালায় কিছুদিন ধরেই আনাগোনা করছিলেন জেফরি ডাহমার। ১৯৯১ সালের ২২ জুলাই সন্ধ্যায়ও যথারীতি সেখানে উপস্থিত ছিলেন তিনি। ৩১ বছর বয়সী স্বর্ণকেশী শ্বেতাঙ্গ এই যুবককে নিয়ে কদিন ধরেই ক্লাবে আসা নর্তকদের মধ্যে কানাকানি আর হাসিঠাট্টা চলছিল। বিশেষ করে বিয়ার অফার করে নর্তকদের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা অনেকের দৃষ্টি এড়ায়নি। বিনা মূল্যে বিয়ারের আশায় কেউ কেউ আবার তাঁর সঙ্গে খাতির জমানোর চেষ্টাতেও ছিলেন।
যুক্তরাষ্ট্রের উইসকনসিন অঙ্গরাজ্যের মিলওয়াকিতে অবস্থিত সেই পানশালায় সেদিন সন্ধ্যায়ও কৃষ্ণাঙ্গ তিন নর্তককে বিয়ার অফার করেন জেফরি। শুধু বিয়ারই নয়, ওই তিন নর্তকের যেকোনো একজনকে তাঁর সঙ্গে বাসায় যাওয়ারও প্রস্তাব দেন। বিনিময়ে দেবেন ৫০ ডলার। কাজ খুব বেশি নয়। জামাকাপড় খুলে উলঙ্গ হয়ে পোজ দিতে হবে শুধু। কয়েকটি ছবি তুলবেন নিজেকে শিল্পী পরিচয় দেওয়া জেফরি।
প্রস্তাবটি দুজন উড়িয়ে দিলেও লুফে নিয়েছিলেন ৩২ বছর বয়সী ট্রেসি এডওয়ার্ডস নামের নর্তক যুবকটি। সারা রাতের জন্য সেদিন জেফরির সঙ্গে রওনা হন তিনি। কিন্তু মিলওয়াকির অক্সফোর্ড অ্যাপার্টমেন্টে অবস্থিত জেফরির ২১৩ নম্বর ফ্ল্যাটে ঢুকেই কিছুটা ঘোরের মধ্যে পড়ে যান ট্রেসি। ফ্ল্যাটের দরজা খুলতেই উৎকট এক গন্ধ তাঁর নাকে এসে ধাক্কা দেয়। কিছুটা দ্বিধা নিয়েই তিনি ভেতরে প্রবেশ করেন। জেফরি তাঁকে জানান, গন্ধটা আর কিছুর নয়, বাড়ি থেকে শূকরের মাংস পাঠিয়েছিল। কিন্তু সেই মাংস ফ্রিজে রাখলেও বৈদ্যুতিক সংযোগ দিতে ভুলে গিয়েছিলেন তিনি। ফলে যা হওয়ার হলো—সব মাংস পচে গেছে!
ট্রেসি বুঝতে পারেন, খুব খারাপ কিছু ঘটতে যাচ্ছে। তবু অনেক কৌশল এবং কথার ছলে নিজেকে নিরাপদ রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। সুযোগের অপেক্ষা করছিলেন এবং পেয়েও গেলেন। জেফরির একটু অন্যমনস্কতায় হ্যান্ডকাফ পরা হাতেই তাঁর মুখে মোক্ষম এক আঘাত করেন ট্রেসি। জেফরি মেঝেতে পড়ে গেলে ট্রেসি দৌড়ে যান দরজার কাছে। কোনোক্রমে দরজা খুলে বেরিয়েই তিনি দিগ্বিদিক দৌড়াতে শুরু করেন। তাঁর মুখ দিয়ে তখন কেবল একটি শব্দই বের হচ্ছিল—পুলিশ...পুলিশ...।
পুলিশ এবার ট্রেসির দিকে তাকায়। ভাবখানা এমন—তলে তলে এসব চলছে, এর মাঝে আবার পুলিশের কাছে নালিশ কেন? প্রেমিকের সঙ্গে মিলে যাও আর সুখে থাকো।
কিন্তু ট্রেসির হাতের হ্যান্ডকাফটিই সব গন্ডগোল করে দিল। জেফরির কাছে পুলিশ জানতে চাইল, এই হ্যান্ডকাফ কোথায় পেলেন? এর চাবি কোথায়?
চাবি কোথায়—এমন প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়েই কিছুটা হকচকিয়ে যান জেফরি। আসলে একটু আগের ধস্তাধস্তি আর গোলমালে চাবিটি ঠিক কোথায়, মনে করতে পারছিলেন না তিনি। তবু শোয়ার ঘরের একটি ড্রয়ারে চাবিটি রাখা আছে বলে জানান। পুলিশ এবার চাবিটির জন্য ভেতরে প্রবেশ করতে চায়। পুলিশকে না বলার মতো কোনো অজুহাতই মাথায় আসেনি জেফরির। অগত্যা দুই পুলিশ ভেতরে প্রবেশ করে। তারা ট্রেসিকেও ডাকে। কিন্তু ট্রেসি ইশারায় জানিয়ে দেন—না, আপনারাই যান, আমি আর এর মধ্যে নেই।
অনেকে মনে করেন, জেফরির এমন ভয়ংকর অপরাধী হয়ে ওঠার নেপথ্যে ছিল তাঁর শৈশব। ছোটবেলা থেকেই তিনি একটি বিশৃঙ্খল পারিবারিক পরিবেশে বড় হয়েছেন। ১৯৬০ সালের ২১ মে মিলওয়াকির একটি মধ্যবিত্ত পরিবারে তাঁর জন্ম। মা জয়েস ফ্লিন্ট ছিলেন অস্বাভাবিক চরিত্রের অধিকারী। সব সময় স্বামীর মনোযোগের কেন্দ্রে থাকতে পছন্দ করতেন। কিন্তু জেফরির বাবা লিওনেল ডাহমার ছিলেন একজন রসায়নবিদ এবং কাজপাগল মানুষ। সংসারে সময় দেওয়ার সুযোগ পেতেন কম। ফলে এটা-ওটা নিয়ে দাম্পত্য কলহ ছিল নিত্যদিনের ঘটনা। স্ত্রীর অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে প্রায় সময়ই বাড়ি থেকে কয়েক দিনের জন্য বেরিয়ে যেতেন লিওনেল।
জেফরি হাইস্কুলে ওঠার পর ডাহমার পরিবার উইসকনসিন থেকে ওহাইও অঙ্গরাজ্যে চলে যায়। হাইস্কুলে পড়ার সময় ১৪ বছর বয়সেই মদ্যপানে আসক্ত হয়ে পড়েছিলেন জেফরি। জ্যাকেটের পকেটে বিয়ার কিংবা মদের বোতল নিয়ে তিনি স্কুলে যেতেন। এর প্রভাব পড়ে পড়াশোনায়ও। কিছুদিনের মধ্যে নিজের ভেতরে আরও এক অস্বাভাবিক কিছু টের পান জেফরি। বুঝতে পেরেছিলেন, তিনি সমকামী। বিপরীত লিঙ্গের বদলে ছেলেদের প্রতিই যৌন আকাঙ্ক্ষা অনুভব করেন। বিষয়টি এমন পর্যায়ে যায় যে ১৬ বছর বয়সে একদিন রাস্তার পাশে অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকা এক ব্যক্তির সঙ্গেও তিনি মিলিত হয়েছিলেন। মিলনের পর অবশ্য তিনি কিছুটা ভয় পেয়েছিলেন। ভেবেছিলেন, বিষয়টি টের পেয়ে যাবেন ওই লোক এবং তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবেন। তাই একটি ঝোপের আড়ালে বেসবলের ব্যাট নিয়ে ওত পেতে ছিলেন তিনি। লোকটি অবশ্য সেদিন ওই পথে না গিয়ে প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন। তা না হলে ওই লোকই হতেন জেফরির হাতে নির্মমভাবে নিহত হওয়া প্রথম ব্যক্তি।
১৯৭৮ সালে ১৮ বছর বয়সে হাইস্কুল পাস করেন জেফরি। এর কয়েক সপ্তাহ পরই নিজ বাড়িতে তিনি জীবনের প্রথম খুনটি করেন। সেদিন তাঁর শিকার ছিলেন স্টিভেন মার্ক হিকস নামে ১৯ বছর বয়সী এক হিচহাইকার। হিচহাইকার বলা হয় তাদেরই, যারা গন্তব্যে পৌঁছানোর জন্য অন্যের গাড়িতে লিফট নেয়। হাত ওড়াতে দেখে হিকসকে নিজের গাড়িতে তুলে নিয়েছিলেন জেফরি। হিকস যাচ্ছিলেন ওহাইওর চিপ্পেওয়া লেক পার্কে একটি রক ব্যান্ডের কনসার্টে। জেফরি তাঁকে পৌঁছে দেবেন বলেছিলেন। তবে সেখানে যাওয়ার আগে হিকসকে নিজ বাড়িতে কয়েক চুমুক বিয়ার পান করারও অফার করেন তিনি। হিকসের কাছে এই প্রস্তাব ছিল মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি! কনসার্টে যাওয়ার আগে একটু পান করে নিলে মন্দ হয় না। কিন্তু সেই বাড়িতে কয়েক টান গাঁজা আর বিয়ার পানের পরই হিকস বুঝতে পেরেছিলেন জেফরির সমকামিতার বিষয়টি। হিকস তাই ওই বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে চাইছিলেন। ঠিক এমন সময় মেজাজ হারিয়ে তাঁর মাথায় ১০ পাউন্ড ওজনের একটি ডাম্বেল দিয়ে সজোরে আঘাত করেন জেফরি। মেঝেতে লুটিয়ে পড়া হিকসকে পরে গলা টিপে শ্বাসরোধে হত্যা করেন তিনি। একপর্যায়ে জামাকাপড় খুলে হিকসের নগ্ন মরদেহের ওপর হস্তমৈথুনও করেন।
পরদিন হিকসের মৃতদেহটি কেটে টুকরো টুকরো করে বাড়ির পেছনেই মাটিচাপা দেন। এক সপ্তাহ পর সেই টুকরোগুলো আবার ওপরে তোলেন এবং হাড় থেকে মাংস আলাদা করেন। পরে অ্যাসিডে মাংস গলিয়ে বাথরুমের কমোডে ঢেলে ফ্ল্যাশ করে দেন। আর হাড়গুলো গুঁড়ো গুঁড়ো করে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দেন বাড়িসংলগ্ন জঙ্গলে।
সেনাবাহিনী থেকে ফেরার পর জেফরির ঠিকানা হয় আবারও উইসকনসিন। মিলওয়াকির শহরতলি অ্যালিসে দাদির বাড়িতে থাকতে শুরু করেন তিনি। বেসামরিক জীবনে মদ্যপান ছাড়াও শিশুদের সামনে হস্তমৈথুন করা থেকে শুরু করে একটি সমকামী স্নানাগারে অন্তত ১২ জন সঙ্গীকে ঘুমের ওষুধ মেশানো মদ খাইয়ে তাঁদের অচেতন দেহের সঙ্গে যৌনতার মতো নানা অপকর্মে লিপ্ত হয়েছিলেন। এই অভিযোগে পরে তাঁর সদস্যপদও বাতিল করে স্নানাগার কর্তৃপক্ষ। তবে প্রথম খুনের পর দ্বিতীয় খুনটি করতে ৯ বছর সময় লেগেছিল তাঁর। ১৯৮৭ সালের সেপ্টেম্বরে তিনি হত্যা করেন স্টিভেন তুওমি নামে ২৫ বছর বয়সী এক যুবককে। একটি পানশালায় দেখা হয়েছিল দুজনের। পরে তাঁরা শহরের একটি হোটেলে রাত কাটাতে যান। কিন্তু সেই রাতের পরদিন সকালে তুওমিকে রক্তাক্ত ও নিহত অবস্থায় দেখেন জেফরি। স্বীকারোক্তিতে তিনি দাবি করেছিলেন, অচেতন করে যৌন সম্পর্ক করা ছাড়া তুওমির সঙ্গে আর কিছু করার পরিকল্পনা ছিল না তাঁর। কিন্তু রাতের বেলায় কখন কী ঘটল কিছুই মনে ছিল না। পরদিন তুওমির মরদেহটি একটি স্যুটকেসে ভরে হোটেল থেকে বেরিয়ে পড়েছিলেন বলে কেউ কিছু জানেনি।
১৯৯২ সালের বিচারে ১৬টি যাবজ্জীবনসহ মোট ৯৪১ বছরের জামিন অযোগ্য কারাদণ্ড পান জেফরি। তবে জীবনের নির্মম পরিণতি তাঁর জন্যও অপেক্ষা করছিল খোদ কারাগারের ভেতরে। দিনটি ছিল ১৯৯৪ সালের ২৮ নভেম্বর। সেদিন সকালে উইসকনসিনের কলম্বিয়া কারেকশনাল ইনস্টিটিউট কারাগারের ভেতর জেফরির সামনে মূর্তিমান এক যমরূপে হাজির হন যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আরেক বন্দী ক্রিস্টোফার স্কারভার। কারাগারের স্নানাগারের ভেতরে জেফরিকে একটি লৌহদণ্ড দিয়ে মারাত্মকভাবে পিটিয়ে আহত করেন তিনি। নির্মম প্রহারে মাথার খুলি চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে পড়েছিল সিরিয়াল কিলারের। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার আধা ঘণ্টা পর তাঁর মৃত্যু ঘটে।
জেফরির হাতে নিহত ১৭ জনের বেশির ভাগই ছিলেন কৃষ্ণাঙ্গ। ধারণা করা হয়, কৃষ্ণাঙ্গ হত্যার প্রতিশোধ নিতেই জেফরিকে খুন করেন কালো শরীরের ক্রিস্টোফার স্কারভার।