বিশ্বে প্রতিনিয়ত প্রযুক্তি উন্নতি হচ্ছে। প্রযুক্তির প্রভাব মানুষের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে গভীরভাবে প্রভাব ফেলছে। বিশেষ করে শিক্ষাব্যবস্থায় এই পরিবর্তনটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। প্রযুক্তি একদিকে যেমন জীবনকে সহজ করছে অন্যদিকে এটি শিক্ষার ধরন, পদ্ধতি ও কাঠামোর ওপর গভীর প্রভাব ফেলছে। বিশেষ করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) এবং আধুনিক প্রযুক্তির বিকাশে শিক্ষার ভবিষ্যৎ নতুন এক দিগন্তের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ভূমিকা
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মানুষের মেধার মতো চিন্তা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে সক্ষম একটি প্রযুক্তি। যা শিক্ষাক্ষেত্রেও একটি বিপ্লবের সূচনা করেছে। শিক্ষার ক্ষেত্রে এআইয়ের ব্যবহার বিভিন্নভাবে হতে পারে—
ব্যক্তিগত শিক্ষার অভিজ্ঞতা
এআই শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগত প্রয়োজন অনুযায়ী পড়াশোনার উপকরণ প্রস্তুত করতে সক্ষম। বিভিন্ন শিক্ষার্থী বিভিন্ন গতিতে শেখে, আর তাদের এই বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী কাস্টমাইজড লার্নিং প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা সম্ভব হয়েছে। এআই শিক্ষার্থীর পারফরম্যান্স ট্র্যাক করে, তাদের দুর্বল জায়গাগুলো চিহ্নিত করে এবং সেগুলোর ওপর কাজ করার জন্য উপযুক্ত পদ্ধতি বা টিপস প্রদান করতে পারে।
স্মার্ট টিউটরিং সিস্টেম
বিশ্ববিদ্যালয় বা স্কুলের পঠনপাঠন কার্যক্রমে ছাত্র-ছাত্রীদের সহায়ক হিসেবে এআই টিউটরিং সিস্টেম কাজ করতে পারে। এই সিস্টেমগুলো শিক্ষার্থীর প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে, শিক্ষার বিভিন্ন বিষয়ে সহায়তা প্রদান করতে পারে এবং তাদের শিখন প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করতে পারে। এ ক্ষেত্রে, এআই শিক্ষকের মতো কাজ না করলেও, এটি শিক্ষকের সহায়ক হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
ইন্টেলিজেন্ট অ্যাসেসমেন্ট
এআই দ্বারা পরিচালিত মূল্যায়ন পদ্ধতি শিক্ষার্থীদের দক্ষতা যাচাইয়ে আরও কার্যকরী হতে পারে। এখানে মানুষের পক্ষে যেকোনো ভুল বা পক্ষপাতিত্বের সম্ভাবনা কমে যাবে এবং শিক্ষার্থীর প্রকৃত সক্ষমতা অনুযায়ী ফলাফল নির্ধারণ হবে। এআইভিত্তিক সিস্টেম শিক্ষার্থীর প্রতিটি অধ্যায় বা বিষয়ে পারফরম্যান্স বিশ্লেষণ করে দ্রুত ও নির্ভুল মূল্যায়ন করতে সক্ষম।
প্রযুক্তি ও ডিজিটাল শিক্ষার প্রসার
এআই ছাড়াও প্রযুক্তির আরও এক গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো ডিজিটাল শিক্ষার প্রসার। বর্তমান পৃথিবীতে ইন্টারনেটের মাধ্যমে শিক্ষা পাওয়া সহজ হয়েছে। ই-লার্নিং এবং অনলাইন কোর্সের মাধ্যমে যে কেউ, যেকোনো জায়গা থেকে নিজের শিক্ষার মান উন্নত করতে পারছে।
অনলাইন লার্নিং ও কোর্স
বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের প্রথাগত শিক্ষাব্যবস্থা থেকে বের হয়ে অনলাইন প্ল্যাটফর্মে কোর্স অফার করছে, যেখানে শিক্ষার্থীরা ঘরে বসে বিভিন্ন বিষয়ে শিখতে পারছে। এই প্রবণতা কেবলমাত্র কোভিড-১৯ মহামারির সময়েই নয়, বরং তার পরেও বেড়েছে। মাইনড ভ্যালি, কুরসেরা, উডেমি, ইডএক্স ইত্যাদি প্ল্যাটফর্মগুলো বিভিন্ন কোর্স প্রদান করছে, যেগুলো কোনো নির্দিষ্ট স্থানে আটকে না থেকে, শিক্ষার্থীদের যেকোনো জায়গা থেকে শেখার সুযোগ করে দিচ্ছে।
ভার্চুয়াল রিয়েলিটি (VR) ও অগমেন্টেড রিয়েলিটি (AR)
ভার্চুয়াল রিয়েলিটি (VR) ও অগমেন্টেড রিয়েলটি (AR) শিক্ষায় বিশেষ ভূমিকা পালন করছে। বাস্তবজীবন থেকে একটি ভার্চুয়াল পরিবেশে পড়াশোনা বা শিক্ষার প্রয়োগ শিক্ষার্থীদের শেখার অভিজ্ঞতা আরও আকর্ষণীয় ও কার্যকর করে তুলছে। এটি তাদের হাতে-কলমে কাজ করার অভিজ্ঞতা প্রদান করে এবং জটিল ধারণাগুলো সহজ করে শেখাতে সহায়তা করে।
প্রযুক্তির মাধ্যমে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্কে পরিবর্তন
শিক্ষকেরা দীর্ঘকাল ধরে শিক্ষার মূল শক্তি হলেও, প্রযুক্তির আগমন তাদের ভূমিকা কিছুটা পরিবর্তন করেছে। এখন তাঁরা শুধু তথ্য প্রদানকারী নয়, বরং সহায়ক, পথপ্রদর্শক এবং মেন্টরের ভূমিকায় কাজ করছেন। এআই, ডেটা অ্যানালিটিক্স এবং অন্যান্য টুলস শিক্ষকদের এমন দক্ষতা প্রদান করেছে, যাতে তাঁরা শিক্ষার্থীদের পারফরম্যান্স অনুসারে তাদের শেখার পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনতে পারেন।
শিক্ষকের জন্য প্রযুক্তির সহায়ক টুলস
শিক্ষকেরা এখন এআই এবং অন্যান্য প্রযুক্তির সাহায্যে শিক্ষার্থীদের বিষয়ে আরও গভীরভাবে মনোযোগ দিতে পারেন। উদাহরণস্বরূপ, শিক্ষকদের জন্য সেন্ট্রালাইজড ডেটাবেইস তৈরি করা হয়েছে, যেখানে তারা সহজেই শিক্ষার্থীদের প্রোগ্রেস ট্র্যাক করতে পারেন। এই তথ্যের মাধ্যমে তাঁরা নিজেদের পদ্ধতিতে পরিবর্তন এনে শিক্ষার্থীদের ফলাফল উন্নত করতে পারেন।
শিক্ষার্থীদের জন্য আরও বেশি সমর্থন
প্রযুক্তি এবং এআই শিক্ষার্থীদের শুধু শেখার ক্ষেত্রে সহায়তা নয়, তাদের মানসিক স্বাস্থ্য এবং মোটিভেশন বজায় রাখতেও সহায়ক। বিভিন্ন অ্যাপ্লিকেশন, যেমন mindfulness অ্যাপ্লিকেশন ও স্টাডি প্ল্যানিং টুলস শিক্ষার্থীদের মানসিক চাপ কমাতে সাহায্য করছে এবং পড়াশোনায় তাদের মনোযোগ বৃদ্ধি করছে।
প্রযুক্তির চ্যালেঞ্জ ও শিক্ষার অসমতা
প্রযুক্তির এই বিস্তার শিক্ষায় কিছু চ্যালেঞ্জও নিয়ে এসেছে। প্রথমত, পৃথিবীর সব জায়গায় এখনো সমানভাবে প্রযুক্তি পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। অনেক জায়গায় ইন্টারনেট সংযোগের সমস্যা, প্রযুক্তির অভাব এবং আর্থিক সমস্যা শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে। অন্যদিকে এআই প্রযুক্তির একটি সীমাবদ্ধতা রয়েছে, বিশেষত যখন এটি শুদ্ধ শিক্ষার প্রতিস্থাপন করার চেষ্টা করে।