দেশের উপকূলীয় এলাকায় অতি নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য কম খরচে ভ্রাম্যমাণ মডুলার ঘর তৈরি করে যুক্তরাজ্যের মর্যাদাপূর্ণ সোয়েন মেডেল পুরস্কার অর্জন করেছেন বাংলাদেশের স্থপতি ও চিন্তাবিদ মেরিনা তাবাসসুম। সম্প্রতি জলবায়ুবিষয়ক শীর্ষ সম্মেলন কপ ২৬ শেষ হওয়ার পরপরই মেরিনা তাবাসসুমকে এই সম্মাননায় ভূষিত করা হলো। স্থানীয় সময় মঙ্গলবার এ পুরস্কারের ঘোষণা দেওয়া হয়।
মেরিনা তাবাসসুম দেশের একজন স্বনামধন্য স্থপতি। এ ছাড়া তিনি মেরিনা তাবাসসুম আর্কিটেক্টস-এর প্রতিষ্ঠাতা। ২০১৬ সালে বায়তুর রউফ মসজিদের নকশা করে তিনি আগা খান অ্যাওয়ার্ড ফর আর্কিটেকচার পুরস্কার অর্জন করেন। এরই ধারাবাহিকতায় এবার তিনি সোয়েন মেডেল পুরস্কার অর্জন করলেন।
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষ বর্ষা মৌসুমে অবর্ণনীয় দুঃসময়ের মধ্য দিয়ে যায়। বন্যায় বিপর্যয় নেমে আসে। বৈশ্বিক উষ্ণতায় হিমবাহ গলে যাওয়ায় সমস্যা আরও ঘনীভূত হচ্ছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে ঘরবাড়ি, জীবিকা হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়ে এখানকার মানুষ। অনেক সময় পলি জমে নতুন ভূমি সৃষ্টি হয়। যাকে ‘চর’ বলা হয়। এসব অঞ্চলের মানুষের জন্য ভবন নকশা করেই প্রশংসিত হচ্ছেন এই স্থপতি।
স্থপতি মেরিনা তাবাসসুম বলেন, ‘আপনি সত্যিই এটিকে ভূমি বলতে পারেন না। এটি ভেজা। এটি নদীর অন্তর্গত। ভূমিহীনদের জন্য চরগুলো কয়েক বছর পর আশ্রয়ের জায়গা হিসেবে গড়ে ওঠে। তারা সেখানে মাছ ধরেন, চাষবাদ করেন এবং পরিবারের সঙ্গে ঘর বানিয়ে থাকেন।’
গত বছর করোনা মহামারিতে যখন গোটা বিশ্ব ধুঁকছিল, সেই সময়ে সবকিছু স্থবির হয়ে পড়ে। সেই সময়ে কিছুটা অবসর সময় পেয়ে ব-দ্বীপ অঞ্চলের দিকে নজর দেন মেরিনা তাবাসসুম। করোনা সংক্রমণ রোধে যখন লকডাউন চলছিল, তখন ব-দ্বীপ অঞ্চলের অসংখ্য মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়ে। অনেকেই চাকরি হারান। তখন অনেক মানুষ বাধ্য হয়ে অস্থায়ী তেরপল টাঙিয়ে থাকতে শুরু করেন। সে সময়েই বাঁশের তৈরি অভিনব ঘর বানিয়ে গৃহহীনদের পাশে দাঁড়ানোর পরিকল্পনা করেন মেরিনা তাবাসসুম আর্কিটেক্টস-এর প্রতিষ্ঠাতা মেরিনা তাবাসসুম।
মেরিনা তাবাসসুম বলেন, ‘বৈশ্বিক কার্বন নিঃসরণের ক্ষেত্রে অবকাঠামোগত শিল্পায়ন অর্ধেক অবদান রাখে। কিন্তু উপকূলীয় অঞ্চলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের এতে কোনো দায় নেই।’
মেরিনা তাবাসসুম আর্কিটেক্টসের (এমটিএ) বিশেষ দিক হচ্ছে, তাঁরা প্রাকৃতিক পরিবেশের সঙ্গে সংগতি রেখে ভবনের নকশা করে থাকেন। এ ক্ষেত্রে স্থানীয় উপকরণ ব্যবহার করে এবং স্থানীয় সম্প্রদায়ের কথা মাথায় রেখে নকশা সাজানো হয়।
এমটিএ বর্তমানে দক্ষিণ-পূর্ব বাংলাদেশের কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শরণার্থীশিবিরে কাজ করছে। এ প্রসঙ্গে মেরিনা তাবাসসুম বলেন, ‘এখানে কাজ করার প্রধান চ্যালেঞ্জ হলো এখানে খুব সুন্দর কিছু হোক এটা সরকার চায় না। কেননা সরকারের আশঙ্কা খুব সুন্দর কিছু হলে উদ্বাস্তুরা (রোহিঙ্গা) এখানে থেকে যেতে পারে এবং তাঁরা আর ফিরে যেতে চাইবে না।’
উল্লেখ্য, এমটিএ সৃষ্টিশীল কাজের মধ্যে বায়তুর রউফ মসজিদ উল্লেখযোগ্য। এটি ২০১২ সালে ঢাকায় নির্মিত হয়, যা রাজধানী ঢাকার আবদুল্লাহপুরে অবস্থিত। প্রাকৃতিক উপায়ে মসজিদের ভেতরে আলো-বাতাস প্রবেশের জন্য মসজিদটিকে এক বিশেষ নকশায় তৈরি করা হয়েছে। আলো-বাতাস প্রবেশের জন্য মসজিদের ছাদে বিভিন্ন জায়গায় ছোট ছোট বৃত্তাকার নকশা করা হয়েছে। ফলে সূর্যের আলো সরাসরি ভেতরে প্রবেশ করে। এই মসজিদের নকশা করে মেরিনা তাবাসসুম ২০১৬ সালে আগা খান অ্যাওয়ার্ড ফর আর্কিটেকচার পুরস্কার অর্জন করেন।