বছর তিনেক আগের কথা। বান্দরবানের রুমা উপজেলা। কেওক্রাডংয়ের পাদদেশে দার্জিলিং পাড়া। সেখানে গিয়ে আস্তানা গেড়েছি মেঘলা দিদিদের কটেজে। বাড়ির পেছনে ছোট্ট একটি পাহাড়ে হয়েছে আদার চাষ। সকালে ঘুম ভাঙার পর সেখানে ওঠে সামনে তাকাতেই চোখে পড়ল কেওক্রাডং ফেরত পর্যটকেরা হেঁটে ফিরছেন পাড়ার মাঝের মাঠ ধরে। তারপরই চোখ গেল উল্টো দিকে। আর তাতেই চমকালাম। মাঝারি উচ্চতার পাহাড়টায় ঘন গাছপালার সারি। কোনো কোনোটি হয়তো শত বর্ষের সীমানা পেরিয়েছে। এর পাশে একটু দূরে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা আরেক পাহাড়েও গাছপালার ঠাসবুনোট।
পরে দার্জিলিং পাড়ার মানুষদের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারলাম জঙ্গলে ঠাসা পাহাড় দুটি বন্যপ্রাণীর আড্ডাখানা। মায়া হরিণ আছে সেখানে। আর আছে মাথা গরম ভালুকেরা।
আজ ২১ মার্চ, আন্তর্জাতিক বন দিবস। তাই চলুন আরও কয়েকটি অরণ্যের গল্প শুনি। কাপ্তাইয়ে বন বিভাগের রাম পাহাড় বিট অফিস থেকে চমৎকার দেখা যায় সীতা পাহাড়ের অরণ্য। ২০০৬-৭ সালের দিকে প্রথম যখন সেখানে যাই তখনই কর্ণফুলীর ওপাশের সীতা পাহাড়ের অংশটা দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম। প্রাচীন সব গাছপালা, লতা-গুল্ম মিলে এমন একে দেখে মনে হচ্ছিল কল্পরাজ্য থেকে ওঠে আসা প্রাগৈতিহাসিক কোনো অরণ্য। কেন যেন ঘুরে-ফিরে স্যার আর্থার কোনান ডয়েলের বিখ্যাত বই লস্ট ওয়ার্ল্ডের কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল।
সীতা পাহাড়ের অরণ্যে ডানা মেলা এক শিকারি ইগলকে দেখে ভাবছিলাম লস্ট ওয়ার্ল্ড বা হারানো পৃথিবীর টেরোড্যাকটিলের কথা। পরদিন ভোরে সীতা পাহাড়ের ওপরে গাছের ডালে খেলা করা হনুমানগুলিকে হাতের আঙুলের চেয়ে বড় দেখাচ্ছিল না কোনোমতেই। পরে অবশ্য আরও বেশ কয়েক বার গিয়েছি কাপ্তাইয়ে। উঠেছি সীতা পাহাড়ের চূড়ায়ও।
বাঘের খোঁজে বান্দরবানের গহিনে, হাতির খোঁজে রাঙামাটির কাসালং, চিতার খোঁজে কাপ্তাই মুখ খাল—কত জঙ্গলে যে চষে বেরিয়েছি। যেখানেই গিয়েছি পেয়ে বসেছে হতাশা, চোখের কোণে অজান্তেই জমা হয়েছে জল। কাসালংয়ের মাইনির বন বাংলোতে গিয়ে দেখি চারপাশে বনের ছিটেফোঁটা নেই। অথচ এনায়েত মাওলা ষাট-সত্তর বছর আগে মাইনির ধারেই চিতা বাঘ-বাঘ শিকার করেছেন। সাঙ্গুর দিকে যাওয়ার সময় ২০১১ সালে রেমাক্রির ধারে একটা পাহাড় দেখিয়ে আমাদের মধ্যবয়স্ক মারমা গাইড বলছিলেন, তাঁর বালক বয়সে লুকিয়ে সেখানে বাঘ দেখার গল্প। মধুপুরে গিয়ে মনে পড়েছে ১৯৫০ সালের আশপাশে এদিকেও ছিল বাঘের রাজত্ব। চিতা বাঘ ছিল ওখানে মুক্তিযুদ্ধের আশপাশের সময়। ভাওয়াল-মধুপুরের অরণ্যের অবস্থাও মোটেই ভালো নয় এখন।
সিলেটের বনগুলোতে গিয়েও মন খারাপ হতো পুরোনো দিনের কথা ভেবে। আবদুর রহমান চৌধুরী সুনামগঞ্জের লাউর এলাকায় ও খাসিয়া পাহাড়ে বাঘ-হাতির যে রাজ্যের কথা বলে গিয়েছেন তা কোথায় হারাল! তখন সেখানে ছিল গভীর বনানী। নানির মুখে শোনা গোয়াল থেকে বাঘ গরু নিয়ে যাওয়ার গল্প কিংবা নানার বাড়ির কাছে দুই ভাইয়ের খালি হাতে বাঘ শিকারের ঘটনা, সাতছড়িতে চিতা বাঘের গাড়ির কাচে থাবা চালানোর সেই সব ঘটনা মনে পড়লেও অদ্ভুত এক রোমাঞ্চ-অনুভূতি ছড়িয়ে পড়ে শরীরে।
তবে তখন বুঝতে পারিনি সামনে আরও খারাপ দিন আসছে। যত দিন গড়াচ্ছে তত বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। কয়েকটা উদাহরণই যথেষ্ট। কির্সতং-রুংরাংয়ের মায়ায় পড়েছেন অনেক অরণ্যপ্রেমীই। যে ধনেশ পাখির নামে রুংরাং-র নাম সেখানে এখন ধনেশ পাখির দেখা পাওয়া ভার। ক্রিসতংও হারিয়েছে আগের আদিম চেহারা। বছর তিনেক আগে কেওক্রাডং গিয়ে শুনেছিলাম ধনেশ পাখির ঠোঁট বিক্রির খবর।
অথচ বন আর বন্যপ্রাণী মানুষের কম উপকার তো করে না। আমাদের ছেড়ে দেওয়া কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্রহণ করে গাছ। পৃথিবীর কার্বন-ডাই-অক্সাইডের বড় সংরক্ষণাগার এই অরণ্য। শুধুমাত্র গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অরণ্যগুলোতেই ২ হাজার ৫০০ কোটি টন সংরক্ষিত আছে কোনো না কোনোভাবে। গাছপালা আমাদের বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় অক্সিজেনও সরবরাহ করে।
মাটি থেকে পানি নিয়ে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে ছেড়ে দেয় গাছ। তাই বড়সড় জায়গা নিয়ে বিস্তৃত জঙ্গলগুলো নিজেদের একটা ক্ষুদ্র জলবায়ু এলাকা তৈরির পাশাপাশি আবহাওয়াতে ভূমিকা রাখতে পারে। যেমন. দক্ষিণ আমেরিকার আমাজনের জঙ্গল শুধু এর ভেতরে ও আশপাশে বৃষ্টিপাত ঘটাতে ভূমিকা রাখে তা নয়, এমনকি উত্তর আমেরিকার বিশাল সমতলভূমিতেও বৃষ্টি ঝরতে পারে এর প্রভাবে।
আরও অনেক উপকারিতাই আছে বন ও এর গাছপালার। সেগুলো না হয় তোলা থাকল অন্য কোনো দিনের জন্য।
সূত্র: বনের উপকারিতার কিছু তথ্য ট্রি হাগার ডট কম ও ব্লগ ডট টেনট্রি ডট কম থেকে নেওয়া হয়েছে।