খরার কারণে দক্ষিণ আমেরিকার বৃহত্তম মিষ্টি পানির হ্রদ টিটিকাকার পানি আশঙ্কাজনক ভাবে কমে গেছে। এতে চারপাশে বাস করা এবং হ্রদটির ওপর নির্ভরশীল আদিবাসীদের জীবনধারণ কঠিন হয়ে পড়েছে। জানুয়ারির আগে পরিস্থিতির উন্নতির সম্ভাবনাও কম। এসব তথ্য জানা যায় ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম গার্ডিয়ানের এক প্রতিবেদনে।
‘জন্মের পর প্রথম এতটা শুকিয়ে গেল এটি,’ বলেন ৪৮ বছর বয়স্ক উরো নারী রিতা সুয়ানা। আলতিপানোর এই আদিবাসীরা পেরু-বলিভিয়া সীমান্তে পড়া টিটিকাকা হ্রদের ওপর নির্ভরশীল।
‘এখানে মাছ ধরতে অভ্যস্ত আমরা। তবে এখন আর এটা করতে পারব না। এখানে মাছ ছিল, পাখির খাবার শেওলা ছিল। কিন্তু এখন কিছু নেই। সব শুকিয়ে গেছে। খুব দুঃখজনক।’ হ্রদের মূল অংশের সঙ্গে উরোদের ভাসমান দ্বীপকে সংযুক্ত করা নালা ধরে নৌকা চালিয়ে যেতে যেতে বলেন রিতা।
খালের চারপাশের ভূ-প্রকৃতি রুক্ষ ও শুষ্ক। তীব্র খরা এই আদিবাসীদের জমিগুলোর অবস্থা শোচনীয় করে তুলেছে। উরোদের কাছে এই হ্রদ বড় পবিত্র জায়গা।
হ্রদের পেরুর অংশে ততোরা নলখাগড়ার ১০০ টির বেশি প্ল্যাটফর্ম পানির ওপর দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। হাজার দুয়েক উরো আদিবাসীর বসবাসের এবং কাজের জায়গা এগুলো। এদিকে শুকনো জায়গায় বাস করা উরোদের সোয়া মাইলের মতো হেঁটে যেতে হচ্ছে মাছ কিংবা হস্তশিল্পজাত বিভিন্ন বস্তু বিক্রি করতে। অথচ আগে নৌকায় চেপেই দূরত্বটি পেরোতে পারতেন তাঁরা। বৃষ্টি না থাকায় জল বাষ্পীভূত হয়েছে। খটখটে শুকনো, ফাটল ধরা জমিতে পড়ে আছে নৌকাগুলি।
পেরুর ন্যাশনাল মেটিওরোলজিক্যাল অ্যান্ড হাইড্রোলজিক্যাল সার্ভিস, পুনোর (টিটিকাকা হ্রদের তীরের একটি শহর) পরিচালক সিক্সতো ফ্লোরেসের মতে পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। ‘হ্রদের জলের পতন এখনো উল্লেখযোগ্য হারে হচ্ছে, কেউ একে থামাতে পারবে না।’ বলেন তিনি।
হ্রদটি সাগরপৃষ্ঠ থেকে সাধারণত ৩ হাজার ৮১২ মিটার (১২ হাজার ৫০০ ফুট) উচ্চতায় থাকে। কিন্তু প্রবল খরায় এই উচ্চতা নেমে এসেছে ৩ হাজার ৮০৮ মিটারে (১২ হাজার ৪৯৩ ফুট)।
টিটিকাকা টুরিস্ট ট্রান্সপোর্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি হুয়ার রামোসের মতে ৩১ অক্টোবর থেকে নভেম্বরের মধ্যে ৪ সেন্টিমিটার উচ্চতা কমেছে হ্রদের। প্রতিদিন বাষ্পীভূত হচ্ছে ৩ লাখ ৫৭ হাজার লিটার পানি।
পানির এই ধারাবাহিক পতনে কোনো কোনো জায়গায় নৌকার তলা মাটিতে লেগে যাচ্ছে। লম্বা কাঠের লাঠির সাহায্যে মাটিতে ধাক্কা দিয়ে এগোতে হচ্ছে মাঝিদের।
‘বর্তমানে পেরুভিয়ান টিটিকাকা ফরেস্ট রিজার্ভের ১৬ হাজার হেক্টর ততোরার ৮০ শতাংশ শুকিয়ে গেছে। এমনকি বন্যপ্রাণীরাও অন্য এলাকায় সরে পড়ছে।’ বলেন রিজার্ভের প্রধান ভিক্টর আপাজা।
এই এলাকার ঘর-বাড়ি তৈরিতেও প্রভাব ফেলছে খরা। কারণ ঘর তৈরি করা হয় ততোরা দিয়ে। ১৫ দিন পর কিংবা নিদেন পক্ষে মাসে একবার ততোরা ভিজে পচে যায়। সে ক্ষেত্রে নতুন উদ্ভিদ দিয়ে এগুলো প্রতিস্থাপন করতে হয়।
হ্রদের পুরোটাই অবশ্য শুকনো নয়। পুনোর প্রধান ঘাটে পর্যটকেরা এখনো আসছেন। উদ্দেশ্য এখনো হ্রদের যতটুকু প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অবশিষ্ট আছে তা দেখা। তবে পানি কম থাকায় নৌকা নিয়ে বিভিন্ন পর্যটন স্পটে তাঁদের পৌঁছে দিতে গলদঘর্ম হচ্ছেন মাঝিরা। পুনোর মূল ঘাট যেখানে সেখানেও পানির উচ্চতা কমেছে ৬০ সেন্টিমিটার।
ফ্লোরস জানান হ্রদের পানির লেভেল পরীক্ষা করে দেখা যায় ২০১৩ সাল থেকে বর্ষা মৌসুম সংক্ষিপ্ত হচ্ছে। ২০২২-২৩ সালে খরা চরম আকার ধারণ করে। এল নিনোর কারণে এ সময় বৃষ্টিপাত হয়েছে গড়ের অর্ধেক।
ফ্লোরস মনে করেন জানুয়ারির আগ পর্যন্ত পর্যাপ্ত বৃষ্টি হবে না। ‘তার মানে হ্রদের পানি ডিসেম্বর পর্যন্ত কমা অব্যাহত থাকবে।’ বলেন ফ্লোরস।