হোম > পরিবেশ

দাবানলের জন্য জলবায়ু পরিবর্তন কতটা দায়ী

অনলাইন ডেস্ক

আপডেট: ১৩ জানুয়ারি ২০২৫, ২১: ৫২
অনেক অঞ্চলে দাবানল একটি সাধারণ ঘটনা হলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এর তীব্রতা ও ভয়াবহতা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। ছবি: এএফপি

টানা ছয় দিন ধরে ভয়াবহ দাবানলে পুড়ছে যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলেস শহরের বিস্তীর্ণ এলাকা। এই ঘটনায় এখন পর্যন্ত ২৪ জনের প্রাণহানি ঘটেছে এবং ১২ হাজারের বেশি স্থাপনা পুড়ে ছাই হয়েছে। অনেক অঞ্চলে দাবানল সাধারণ ঘটনা হলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এর তীব্রতা ও ভয়াবহতা বেশ বেড়েছে। বিজ্ঞানীদের মতে, বর্তমান বিশ্বে দাবানলের তীব্রতা বাড়ার অন্যতম প্রধান কারণ জলবায়ু পরিবর্তন। তবে ক্যালিফোর্নিয়ার দাবানলের জন্য জলবায়ু পরিবর্তন কতটা দায়ী, তা নিয়ে এখনো গবেষকদের কাছে স্পষ্ট তথ্য নেই।

গত শুক্রবার ২০২৪ সালকে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে ‘উষ্ণ বছর’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের কোপার্নিকাস ক্লাইমেট চেঞ্জ সার্ভিস। তবে লস অ্যাঞ্জেলেসের দাবানলে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির প্রভাব স্পষ্টভাবে বলা এখনো কঠিন। কারণ, সব দাবানলই জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে হয় না। তবে ‘ওয়ার্ল্ড ওয়েদার অ্যাট্রিবিউশন’ নামের একটি বৈজ্ঞানিক দলের গবেষণায় দেখা গেছে, জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সাম্প্রতিক কিছু বড় দাবানলের সম্পর্ক রয়েছে।

যেসব দাবানলের জন্য জলবায়ু পরিবর্তন দায়ী
ব্রাজিলের প্যান্টানাল জলাভূমিতে গত জুনে ভয়াবহ দাবানলের ঘটনা ঘটে। তবে এটি দেশটির সাধারণ দাবানল মৌসুমের বাইরে ঘটেছিল। এই দাবানলের ফলে এক মাসের মধ্যে প্রায় ৪ লাখ হেক্টর জমি ধ্বংস হয়ে যায়।

২০২৩ সালের বসন্তের শেষের (মার্চ-মে) দিকে পূর্ব কানাডায় ঘটে যাওয়া দাবানলগুলোর সঙ্গে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির একটি সম্পর্কও স্থাপন করেছেন বিজ্ঞানীরা। সেই বছরের মে ও জুন মাস ছিল ১৯৪০ সালের পর সবচেয়ে উষ্ণ মাস। গবেষণায় দেখা গেছে, জলবায়ু পরিবর্তন দাবানল সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনাকে দ্বিগুণের বেশি বাড়িয়েছে। দাবানলগুলোর প্রভাবও বেশ ভয়ংকর ছিল। ২০২৩ সালে বিশ্বব্যাপী যে পরিমাণ বনভূমি ধ্বংস হয়েছে, তার এক-চতুর্থাংশের বেশি এর কারণে হয়েছে।

গ্রীষ্ম ও শরতের সময়ে ক্যালিফোর্নিয়ায় দাবানল একটি সাধারণ ঘটনা। তবে গত কয়েক দশকে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে অঙ্গরাজ্যটির পুড়ে যাওয়া এলাকার পরিমাণ ১৭২ শতাংশ বেড়েছে।

মোটের ওপর, বিশ্বজুড়ে দাবানল আরও বিস্তৃত হচ্ছে এবং গত বিশ বছরে এর সংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে। এসব দাবানল আরও বেশি ভয়ংকর হয়ে উঠছে।

একইভাবে, বনাঞ্চলের দাবানলও আরও ঘন ঘন হচ্ছে। এক গবেষণায় দেখা গেছে, দাবানলের কারণে বর্তমানে যে পরিমাণ গাছপালা ধ্বংস হচ্ছে, তা দুই দশক আগের তুলনায় অন্তত দুই গুণ বেশি। ২০০১-২০২৩ সালের মধ্যে দাবানলে হারানো বনভূমির প্রায় ৭০ শতাংশ বোরিয়াল বনাঞ্চলসম্পন্ন দেশগুলোতে ঘটেছে। যেমন কানাডা ও রাশিয়া। জলবায়ু পরিবর্তনকে এই দাবানল কার্যকলাপের প্রধান কারণ হিসেবে দেখা হচ্ছে।

উল্লেখ্য, পৃথিবীর উত্তর অংশে অবস্থিত একটি বিশেষ ধরনের বনাঞ্চলকে বোরিয়াল অঞ্চল বলা হয়। এই ধরনের বনের গাছপালা সাধারণত শীতে তীব্র ঠান্ডা এবং গ্রীষ্মকালে মাঝারি তাপমাত্রা সহ্য করতে পারে। বোরিয়াল বনে প্রধানত সিডার, স্প্রুস, পাইন ও তাম্বুলগাছ থাকে এবং এর বিস্তৃতি কানাডা, রাশিয়া, স্ক্যান্ডিনেভিয়া ও অন্যান্য উত্তরাঞ্চলে রয়েছে।

তাপমাত্রা দাবানলের ওপর প্রভাব ফেলে যেভাবে
দাবানলগুলো সরাসরি জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে হয় না; তবে বেশির ভাগ দাবানল মানুষের কর্মকাণ্ডের কারণে শুরু হয়। জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানোর ফলে গ্রিনহাউস গ্যাসের নিঃসরণ বেড়ে গেছে, যা বৈশ্বিক তাপমাত্রা বাড়ার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব কর্মকাণ্ড চরম মাত্রার তাপমাত্রা বৃদ্ধির সম্ভাবনাকে আরও বাড়িয়েছে।

গরম তাপমাত্রার পৃথিবী ‘ফায়ার ওয়েদার’ বা দাবানলের বেশ উপযোগী পরিবেশ তৈরি করে। যেমন প্রচণ্ড গরম, শুষ্কতা এবং প্রবল বাতাসের কারণে আগুন ছড়িয়ে পড়ার জন্য আদর্শ পরিবেশ তৈরি হয়।

খরাকে জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত করা কঠিন। খরা সাধারণত একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলে গড়ে তোলা বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমে যাওয়ার ফলে ঘটে। তবে খরা সৃষ্টির কারণ বিভিন্ন অঞ্চলের পরিস্থিতি এবং খরার ধরন অনুযায়ী পরিবর্তিত হতে পারে।

বিজ্ঞানীরা জানান, মাটির আর্দ্রতা কমে গিয়ে যে খরা হয়, তা জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে বেশি সম্পর্কিত। তবে যেগুলো নদী বা ভূগর্ভস্থ পানির স্তরের কমে যাওয়ার কারণে ঘটে, সেগুলোর জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে তুলনামূলকভাবে কম সম্পর্কিত। এ ধরনের খরার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলের মধ্যে পশ্চিম-উত্তর আমেরিকা, ভূমধ্যসাগরের অঞ্চল, আফ্রিকার কিছু অংশ এবং দক্ষিণ আমেরিকার উত্তর-পূর্ব অংশ অন্তর্ভুক্ত।

লস অ্যাঞ্জেলেসের দাবানলগুলোর ক্ষেত্রে ‘হাইড্রোক্লাইমেট উইপল্যাশ’কে প্রধান জলবায়ু কারণ হিসেবে চিহ্নিত করছেন। অত্যন্ত আর্দ্র এবং শুষ্ক আবহাওয়ার দ্রুত পরিবর্তনকে ‘হাইড্রোক্লাইমেট উইপল্যাশ’ বলে।

বিশ্বের সবচেয়ে উষ্ণতম গ্রীষ্মের রেকর্ড গড়ল ২০২৪
গত বৃহস্পতিবার প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে, ২০২২ বা ২০২৩ সালের শীতকালে অস্বাভাবিকভাবে বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছিল এবং আর্দ্র ছিল। এর ফলে ঘাস ও ঝোপ ভালোভাবে বেড়ে ওঠে।

অপরদিকে, ২০২৪ সাল বিশ্বের সবচেয়ে উষ্ণতম গ্রীষ্মের রেকর্ড গড়েছে। এর ফলে সে সময় আবহাওয়া অস্বাভাবিকভাবে বেশি শুষ্ক ছিল এবং এই বছরের বৃষ্টির মৌসুমে দেরিতে শুরু হয়। এর ফলে ঘাস ও ঝোপ শুকিয়ে গিয়ে দাবানলের জ্বালানি হয়ে ওঠে, যা আগুনের দ্রুত বিস্তার ঘটাতে সাহায্য করে।

মার্কিন গবেষণা সংস্থা ওয়ার্ল্ড রিসোর্স ইনস্টিটিউট অনুযায়ী, চলতি বছরের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত লস অ্যাঞ্জেলেসে ২০১২-২০২৪ এর তুলনায় ৪০ গুণ বেশি দাবানল সতর্কতা দেখানো হয়েছে।

যেসব পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে
গত বছর ইউরোপীয় পরিবেশ এজেন্সির জলবায়ু ঝুঁকি মূল্যায়ন বিশেষজ্ঞ জুলি বার্কম্যানস বলেন, পূর্বাভাস ব্যবস্থা উন্নত করার জন্য বেশি তহবিল প্রয়োজন। যেহেতু অধিকাংশ দাবানল মানবিক কর্মকাণ্ডের কারণে শুরু হয়, তাই সেই সঙ্গে বন ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে আরও নির্দেশনা ও জনসচেতনতা বাড়ানো প্রয়োজন।

ইউরোপে দাবানল আরও বাড়ছে এবং তীব্র হচ্ছে। তাই দাবানল মোকাবিলায় তাদের পদক্ষেপ বাড়াচ্ছে কর্তৃপক্ষরা। ২০২৩ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সিভিল প্রোটেকশন মেকানিজম এবং রেসকিউ প্রোগ্রামগুলো তাদের বিমান, হেলিকপ্টার এবং ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের সংখ্যা দ্বিগুণ করেছে। এ ছাড়া ২০৩০ সালের মধ্যে সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য ৬০০ মিলিয়ন ইউরো (৬১৫ মিলিয়ন ডলার) বরাদ্দ করেছে।

কিছু বিশেষজ্ঞ বলছেন, দাবানল প্রতিরোধে আরও বেশি সম্পদ বিনিয়োগ করতে হবে। এর মধ্যে বনগুলোকে আরও শক্তিশালী করা, যেমন একধরনের গাছ রোপণের পরিবর্তে বিভিন্ন ধরনের গাছ রোপণ করা, গাছগুলোর মাঝে সঠিক ব্যবধান রাখা এবং কিছু নির্দিষ্ট জায়গায় আগুন দিয়ে মাটির উদ্ভিদ কমানো। এ ছাড়া ভেড়া ও গরুর মতো প্রাণী চরানোও সহায়ক হতে পারে।

গত বছর ইউরোপীয় বন ইনস্টিটিউটের সিনিয়র বিশেষজ্ঞ আলেক্সান্ডার হেল্ড বলেন, নাগরিকদের মধ্যে প্রতিরোধমূলক আচরণ উৎসাহিত করাও গুরুত্বপূর্ণ।

তথ্যসূত্র: ডয়চে ভেলে

বায়ুদূষণ রোধে অভিযান: ২৪ লাখ টাকা জরিমানা

ঢাকার বাতাস খুবই অস্বাস্থ্যকর, মাস্ক পরার পরামর্শ আবহাওয়া অধিদপ্তরের

কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহরে পরিণত হলো ঢাকা

সেকশন