বাংলাদেশের সোশ্যাল মিডিয়া ও সংবাদমাধ্যমে দেশের জনসংখ্যা নিয়ে সম্প্রতি দাবি ব্যাপকভাবে প্রচার করা হচ্ছে। ‘বিশ্ব জরিপ সংস্থা’ নামে ভূঁইফোঁড় প্রতিষ্ঠানের বরাত দিয়ে দাবি করা হচ্ছে, বাংলাদেশের জনসংখ্যা ৪০ কোটি ছাড়িয়েছে। গত বুধবার (১৬ অক্টোবর) জাতীয় দৈনিক ইনকিলাব ‘বিশ্ব জরিপ সংস্থা’র মুখপাত্র সাইয়্যিদ মুহম্মদ আকতার ই-কামালের বরাত দিয়ে এমন দাবিতে সংবাদ প্রকাশ করে। ওই দিন সংবাদমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে বাংলাদেশের জনসংখ্যার নতুন এই চিত্র প্রকাশ করে কথিত বিশ্ব জরিপ সংস্থা। বিবৃতিতে আকতার ই-কামাল বলেন, ‘১৯৯৭ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের জনসংখ্যা ছিল প্রায় ১৭ কোটি। এরপর থেকে বিগত ২৭ বছরে জনসংখ্যার একই হিসাব দেওয়া হচ্ছে। এর পেছনে সরকারের পাশাপাশি কাজ করেছে বিভিন্ন এনজিও। দেশের জনসংখ্যা কমাতে বিদেশি দাতা সংস্থা কর্তৃক দেওয়া তহবিলের সঠিক ব্যবহার হয়েছে— এটা প্রমাণ করাই ছিল জনসংখ্যা কম দেখানোর আসল উদ্দেশ্য।’
১৯৬৯ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত ২৭ বছরের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার দেখিয়ে আকতার-ই-কামাল দাবি করেন, ‘এই সময়ে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার সোয়া তিন গুণেরও (৩.২৬ গুণ) বেশি। তাহলে ১৯৯৬ থেকে ২০২৪ সালের এই ২৮ বছরেও জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ৩ / ৪ গুণ বাড়ার কথা। কারণ হিসেবে তিনি বলেছেন, পূর্বের চেয়ে এ সময়ে গড় আয়ু বেড়েছে। বর্তমানে ৪০ কোটি জনসংখ্যা ধরলে সেটা আড়াই গুণেরও কম (২.৩৫ গুণ) হয়। কাজেই বাস্তবতা হচ্ছে- বর্তমানে বাংলাদেশের জনসংখ্যা ৪০ কোটি ছাড়িয়ে গেছে। আর সোয়া তিন গুণ হিসাব করলে জনসংখ্যা হয় প্রায় ৫৫ কোটি।’
বিশ্ব জরিপ সংস্থা কি নির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠান?
আজকের পত্রিকার ফ্যাক্টচেক বিভাগ বাংলাদেশের জনসংখ্যা নিয়ে প্রকাশিত দাবিটির সত্যতা যাচাই করেছে। দাবিটি প্রকাশকারী প্রতিষ্ঠান বিশ্ব জরিপ সংস্থা সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে এই নামে একটি ফেসবুক পেজ পাওয়া যায়। ২০১৬ সালের ৭ আগস্ট খোলা পেজটিতে ফলোয়ার সংখ্যা মাত্র ৩৮৭। পেজটিতে গত শুক্রবার (১৮ অক্টোবর) বাংলাদেশের জনসংখ্যা ৪০ কোটি ছাড়িয়েছে সম্পর্কিত পোস্টটি করা হয়। এর আগের পোস্টটি ২০১৮ সালের ৫ মে। সংস্থাটির কোনো ওয়েবসাইট পাওয়া যায়নি। সংস্থাটির কথিত মুখপাত্র সাইয়্যিদ মুহম্মদ আকতার ই-কামাল সম্পর্কেও কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
কথিত বিশ্ব জরিপ সংস্থার বিবৃতিটিতে বাংলাদেশের জনসংখ্যা ৪০ কোটি ছাড়ানোর দাবিটির পক্ষে বিশেষ কোনো সূত্র উল্লেখ করা হয়নি। কেবল জনসংখ্যার বৃদ্ধির হার ও গড় আয়ু দেখিয়ে দাবি করা হয়েছে, বর্তমানে বাংলাদেশের জনসংখ্যা ৪০ কোটি ছাড়িয়ে গেছে। কিন্তু একটি দেশের জনসংখ্যার আকারের সঙ্গে আরও বেশ কিছু বিষয় জড়িত। যেমন, স্থানান্তর বা অভিবাসন, প্রজনন উর্বরতা।
জাতিসংঘের ডিপার্টমেন্ট অব ইকোনমিকস অ্যান্ড সোশ্যাল অ্যাফেয়ার্সের পপুলেশন বিভাগের গত ১১ জুলাইয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুসারে, দেশের বর্তমান জনসংখ্যা ১৭ কোটি ৩৪ লাখের কিছু বেশি। প্রজনন হার স্বাভাবিক থাকলে ২০৭১ সালে বাংলাদেশের জনসংখ্যা ২২ কোটি ৬১ লাখ ২৯ হাজার ৮৮৯ জন হবে বলে সংস্থাটির পূর্বাভাস।
জাতিসংঘের জনসংখ্যা বিষয়ক প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে বিবিসি বাংলার বলেছে, জন্মহার কমলেও ২০৫০ সাল নাগাদ বাংলাদেশের জনসংখ্যা হবে ২০ কোটি ৪০ লাখ। ২০৫৭ সালে জনসংখ্যা হবে ২০ কোটি ৭০ লক্ষ। বিশ্ব ব্যাংকের প্রতিবেদনেও ২০২৩ সালের দেশের জনসংখ্যা ১৭ কোটি ২৯ লাখ ৫৪ হাজার ৩১৯ জন বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
বিবিসি বাংলায় ২০২৩ সালে প্রকাশিত আরেকটি প্রতিবেদনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্স বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম বলেন, বর্তমানে দেশের জনসংখ্যা প্রায় ১৭ কোটি বলা হলেও জাতিসংঘের প্রক্ষেপণ মডেল অনুযায়ী এই সংখ্যা আরও বেশি। জাতিসংঘের প্রক্ষেপন মডেল অনুযায়ী, বাংলাদেশে মধ্যম মেয়াদি প্রক্ষেপন ধরা হয় এবং সে অনুযায়ী, এখন থেকে ২৭ বছর পর ২০৫০ সাল নাগাদ বাংলাদেশের জনসংখ্যা হবে ২০ কোটি ৪০ লাখ। বর্তমানে যে হারে জনসংখ্যা বাড়ছে তা আরও ৩৪ বছর অব্যাহত থাকবে। ২০৫৭ সালে জনসংখ্যা হবে ২০ কোটি ৭০ লাখ।
স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত ৬টি আদমশুমারি হয়েছে। এগুলো হয়েছে ১৯৭৪,১৯৮১, ১৯৯১,২০০১, ২০১১ ও ২০২২ সালে। এর মধ্যে ১৯৯১ সালে অনুষ্ঠিত আদম শুমারি অনুযায়ী, দেশে তখন জনসংখ্যা ছিল ১৩ কোটি। বিশ্ব ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, ২০০০ সালে বাংলাদেশের জনসংখ্যা ছিল ১২ কোটি ৯১ লাখ ৯৩ হাজার। বাংলাদেশের জনসংখ্যা প্রথম ১৬ কোটির ঘরে পৌঁছায় ২০১৭ সালে।
এসব তথ্য বিশ্লেষণের কোনোটিই কথিত ‘বিশ্ব জরিপ সংস্থা’র বিবৃতিটির সত্যতা নিশ্চিত করে না। এ ছাড়া অনুসন্ধানে বিশ্ব জরিপ সংস্থা কোনো নির্ভরযোগ্য সূত্র বলেও প্রতীয়মান হয় না। ফলে এটি নিশ্চিত যে, বাংলাদেশের জনসংখ্যা ৪০ কোটি ছাড়িয়ে যাওয়ার দাবিটি সঠিক নয়।