‘আমার কবিতা হইলো গ্রামের কর্ম নিয়্যা। চিন্ত্যা ভাবনা করিয়্যা আমি আঞ্চলিক ভাষায় কবিতা লিখি। ফেসবুকে দিচে, অনেক লোক শুনিচে। আমার নাম রাধাপদ সরকার। অন্য মানুষের নামে আমার এই কবিতা যাইতে পারে না।’ নিজের সৃষ্টি অন্যের নামে প্রচার হওয়ায় আজকের পত্রিকার কাছে আক্ষেপ করছিলেন কুড়িগ্রামের নিভৃতচারী কবি রাধাপদ সরকার।
সম্প্রতি একটি ভিডিও রীতিমতো ভাইরাল হয়েছে। শিরোনাম ‘কেয়ামতের নমুনা’। এক মিনিট দৈর্ঘ্যের সাদাকালো ওই ভিডিওতে এক বৃদ্ধ নিজেকে পল্লিকবি হিসেবে পরিচয় দিয়ে বলছেন, ‘যারা কলম ধরা শিখচে, তারাই দ্যাশকে খাইচে। আমি পল্লিকবি, কবিতা বানাই। কিন্তু আমার কবিতা তো কেউ শুনবে না। কারণ, আমরা গরিব মানুষ। গরিব মানুষের কোনো দাম নাই।’ এর পর ওই ভিডিওতে একটা কবিতা আওড়ালেন। ওই কবিতায় উঠে এল বর্তমান সমাজ বাস্তবতা।
কিন্তু ভিডিওর লোকটির সঙ্গে পল্লিকবি জসীম উদ্দীনের ছবির সাদৃশ্য নেই। আঞ্চলিক উচ্চারণ শুনে অনুমান করাই যায়, ভিডিওর ব্যক্তি উত্তরাঞ্চলের কেউ। কিন্তু জসীম উদ্দীনের জন্ম ফরিদপুরে। তাঁর বলা কথায় এমন উচ্চারণ হওয়ার কথা নয়।
তবে ওই পোস্ট থেকে কিছু সূত্র পাওয়া গেল। ক্যাপশনে লেখা হয়েছে—‘কথাগুলো বলেছেন রাধাপদ রায়। তাঁর বাড়ি কুড়িগ্রাম জেলার নাগেশ্বরী উপজেলার ভিতরবন্দ ইউনিয়নে। গ্রামের নাম মাধাই খাল, গোড্ডারারপাড়। তথ্যসূত্র: দীপক কুমার রায়।’
সঙ্গে সঙ্গে আজকের পত্রিকার নাগেশ্বরী প্রতিনিধি আবদুল কুদ্দুস চঞ্চলকে ফোন দেওয়া হলো। ফোন করে নাম বলতেই চিনে ফেললেন কবিকে। বললেন, ‘লোকটির নাম রাধাপদ সরকার। গোদ্ধারের পাড়ের অশীতিপর এক বৃদ্ধ। গাঁয়ের কবি, পল্লিকবি নামেই তাই সবাই চেনে।
পরদিন চঞ্চল গেলেন ওই কবির কাছে। কথা বললেন। ভিডিও ও ছবি তুলে পাঠালেন আজকের পত্রিকার ঢাকা অফিসে।
রাধাপদ সরকার বলেন, তাঁর কবিতা বাস্তবতার নিরিখে আঞ্চলিক ভাষায় রচিত। যা সুর আর তাল দিয়ে গান হয়ে প্রকাশ পায় তাঁর কণ্ঠে। আর এসব গানের শ্রোতা গ্রামের সহজ সরল ছোট-বড় সব শ্রেণির মানুষ। কিছু কবিতা তিনি লিখে রেখেছেন আর কিছু কবিতা তিনি মুখস্থ রেখেছেন।
চঞ্চল জানান, দারিদ্র্য তাঁর জীবনে নিত্যসঙ্গী। কৈশোর থেকেই গ্রামের বিভিন্ন উৎসব, পালা পার্বণসহ গ্রামবাসীর আবদার ও আয়োজনে গান ও কবিতার আসর করে আসছেন তিনি। সেসব আসরে গান ও কবিতা পরিবেশন করে পাওয়া অর্থ দিয়ে সংসার চালান তিনি।
কেয়ামতের নমুনা শিরোনামের কবিতা নেট দুনিয়ায় ভাইরাল হওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন–
‘বিভিন্নজন আমার নাম বাদ দিয়ে অন্য কারও নামে ভিডিওটি ছড়িয়েছে। আমার অনুরোধ আমার কবিতা আমার নামেই প্রচার হোক অন্য কারও নামে নয়।’
মেয়ে অঞ্জলী রানি জানান, এই বয়সেও তাঁর বাবা সাইকেল চালিয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরে গান করেন। এতে তাঁর অনেক কষ্ট হয়। সরকারের সহযোগিতা কামনা করেন তিনি।
কুড়িগ্রামের সাহিত্য সংগঠক ও সাংবাদিক প্রভাষক রফিকুল ইসলাম বলেন, গ্রামীণ জনপদের ঘটনা কিংবা বাস্তবতা দিয়ে তাৎক্ষণিক কবিতা বা গান রচনা করে মুখে মুখে ছড়িয়ে দেওয়া চারণ কবিদের কাজ। রাধাপদ সরকার এমনই একজন চারণ কবি। তাঁর সৃষ্টি সংরক্ষণ করা দরকার।
নাগেশ্বরীর ভিতরবন্দ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আমিনুল ইসলাম খন্দকারও তাঁর প্রতিভা বাঁচিয়ে রাখতে সরকারের সুদৃষ্টি কামনা করেন।
রাধাপদ সরকারের লেখা কবিতাটি
কেয়ামতের নমুনা, জানি কিন্তু মানি না
গুনাহগার দোযখী হবে সে কথাও তো শুনি না
গুন্ডাপান্ডা হারামখোর তারা হইলো দোজখ
দিনদুপুরে মানুষ মারে তারা হইলো দুনিয়া
কেয়ামতের নমুনা জানি কিন্তু মানি না।
সরকারি চাকরি করে, বেতন ৫ হাজার
৫০ হাজার টাকা মাসে খরচ দেখি তার
বাকি টাকা কেমনে আসে, সে কথা আর বলি না
কেয়ামতের নমুনা, জানি কিন্তু মানি না
ডিজেল ভেজাল, পেট্রল ভেজাল, অকটেন ভেজাল
ভেজাল পদ্মা–মেঘনা–যমুনা (অর্থাৎ, কোম্পানি ভেজাল)
কেয়ামতের নমুনা, জানি কিন্তু মানি না।
ভেবে কয় রাধাপদ সরকার
মানুষ হওয়া কী ছিল দরকার
পশু হওয়া ছিল ভালা
আখিরাতের কাজ করি না (অর্থাৎ পরকালের কাজ করি না)
কেয়ামতের নমুনা, জানি কিন্তু মানি না।
সিদ্ধান্ত
ফেসবুকে ‘কেয়ামতের নমুনা’ শিরোনামে ভাইরাল হওয়া কবিতাটি কুড়িগ্রামের রাধাপদ সরকারের লেখা। নিভৃত পল্লিতে বাস করে আঞ্চলিক ভাষায় কবিতা ও গান লিখে গাওয়ার জন্য স্থানীয়ভাবে পল্লিকবি বলেই পরিচিতি পেয়েছেন তিনি। তবে পল্লিকবি হিসেবে জসীম উদ্দীনের নামই দেশের অধিকাংশ মানুষের কাছে পরিচিত। ভিডিওতে রাধাপদ সরকার নিজেকে পল্লিকবি পরিচয় দেওয়ায় এই বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে।