Ajker Patrika
হোম > ফ্যাক্টচেক > জানি, কিন্তু ভুল

সুস্থ থাকতে কি দিনে ১০ হাজার কদম হাঁটতেই হবে

ফ্যাক্টচেক ডেস্ক

সুস্থ থাকতে কি দিনে ১০ হাজার কদম হাঁটতেই হবে

স্বাস্থ্য সুরক্ষায় ব্যায়ামের মধ্যে হাঁটা অন্যতম। একজন মানুষের দিনে কতটুকু হাঁটা প্রয়োজন? আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশনের বরাত দিয়ে সামাজিক যোগাযোগেরমাধ্যমে বলা হচ্ছে, দিনে ১০ হাজার কদম বা পা হাঁটা স্বাস্থ্যের জন্য ভালো। পদক্ষেপ মাপার জন্য পেডোমিটার ব্যবহারের পরামর্শ দেওয়া হয়। তা ছাড়া প্রায় সব স্মার্টফোনে অ্যাপ, স্মার্টওয়াচ, ফিটনেস ওয়াচেও এই সুবিধা আছে। তাই অনেক স্বাস্থ্যসচেতন মানুষ হাঁটার সময় বা সারা দিনের কর্মব্যস্ততা শেষে ঘরে ফিরে হাতের মোবাইল বা হাতের স্মার্টওয়াচটিতে দেখে নেন দিনে হাঁটার এই লক্ষ্য পূরণ হলো কি না।

অনেক চিকিৎসকও এই পরামর্শ দিয়ে থাকেন, প্রতিদিন অন্তত ১০ হাজার কদম হাঁটা উচিত। বাংলাদেশ ইউএস পিপলস হসপিটালের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান ডা. মাওলানা মোহাম্মদ মোয়াজ্জেম হোসেন এক টিভি সাক্ষাৎকারে বলেন, প্রতিদিন অন্তত ১০ হাজার কদম হাঁটা উচিত। এটি যাঁরা না পারবেন, তাঁরা সপ্তাহে অন্তত তিন দিন ১০ হাজার কদম হাঁটবেন। এতে সুস্থ থাকতে পারবেন।

কিন্তু আসলেই কি সুস্থ থাকতে ১০ হাজার কদম হাঁটা আবশ্যক, বৈজ্ঞানিক গবেষণা কী বলে? ১০ হাজার কদম হাঁটার ধারণাই-বা কীভাবে এল?

প্রথমে জানা যাক, আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশন ১০ হাজার কদম হাঁটা প্রসঙ্গে আসলে কী বলেছে? প্রতিষ্ঠানটির ওয়েবসাইটে ২০২১ সালের ১৬ নভেম্বর সুস্বাস্থ্যের জন্য ১০ হাজার কদম হাঁটা প্রসঙ্গে একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়। এতে প্রতিষ্ঠানটি জানায়, সুস্বাস্থ্যের জন্য প্রতিদিন ১০ হাজার কদম হাঁটার ধারণাটি কোনো ডাক্তার বা শারীরিক প্রশিক্ষকদের কাছ থেকে আসেনি। 

ধারণাটি এসেছে ১৯৬০-এর দশকের মাঝামাঝি জাপানি কিছু বিপণনকারীর কাছ থেকে। ওই সময় তাঁরা একটি পেডোমিটার বিক্রি করার চেষ্টা করেন, যার নাম ছিল মানপো-কেই। ইংরেজি ভাষায় যার অর্থ দাঁড়ায়, ‘১০ হাজার কদম মাপার মিটার।’ আবার জাপানি ভাষায় ১০ হাজার লেখার জন্য ব্যবহৃত বর্ণগুলোও মোটামুটি একজন ব্যক্তির হাঁটার সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ।

এ প্রসঙ্গে আমহার্স্টের ম্যাসাচুসেটস বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব পাবলিক হেলথ অ্যান্ড হেলথ সায়েন্সেসের সহকারী অধ্যাপক আমান্ডা পালুচ আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশনকে বলেন, ১০ হাজার সংখ্যাটি মনে রাখতে সহজ ও সুন্দর একটি নম্বর। এটি ভালো বিপণন বার্তাও দেয়। 

তবে এর পেছনে খুব বেশি বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। আমান্ডা পালুচ হাঁটার সঙ্গে কার্ডিওভাসকুলার বা হৃৎপিণ্ড ও রক্তনালি-সম্পর্কিত রোগের গবেষণা প্রকল্পের প্রধান গবেষক। এতে দেখা যায়, সুস্বাস্থ্যের জন্য হাঁটার কোনো ম্যাজিক নম্বর নেই। ১০ হাজার কদমের চেয়ে কম যেকোনো সংখ্যাই স্বাস্থ্যকর।

পালুচ বলেন, ১০ হাজার পা হাঁটার সংখ্যাটি মার্কেটিংয়ের জন্য দারুণ হলেও অনেক মানুষের জন্য ভীতিকর হতে পারে। 

যুক্তরাষ্ট্রের এমরি বিশ্ববিদ্যালয়ের এমরি গ্লোবাল ডায়াবেটিস রিসার্চ সেন্টারের সহযোগী অধ্যাপক ফেলিপ লোবেলো বলেন, কার্ডিওভাসকুলার বা হৃৎপিণ্ড ও রক্তনালি-সম্পর্কিত রোগ থেকে সুরক্ষায় ১০ হাজার কদম হাঁটা জরুরি নয়। এই সংখ্যা ৫ থেকে ৬ হাজারের মধ্যে হবে, যা প্রতি সপ্তাহে ১৫০ মিনিট হাঁটার সমতুল্য। 

হার্ভার্ড টি এইচ চ্যান স্কুল অব পাবলিক হেলথের এপিডেমিওলজির অধ্যাপক ডা. আই-মিন লি নিউইয়র্ক টাইমসকে ২০২১ সালে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ১০ হাজার কদম হাঁটার ব্যাপারটি ১৯৬০ সালে জাপানে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। একজন ঘড়িনির্মাতা ১৯৬৪ সালের টোকিও অলিম্পিক গেমসের পরে স্বাস্থ্য সুরক্ষার প্রতি মানুষের আগ্রহকে পুঁজি করে কদম গোনার জন্য পেডোমিটার তৈরি করেছিলেন। জাপানি ভাষায় যার অর্থ ছিল, ‘১০ হাজার কদম মাপার মিটার’। এরপর থেকেই সুস্বাস্থ্যের জন্য ১০ হাজার কদম হাঁটার ধারণাটি জনপ্রিয় হয়ে যায়। তবে আধুনিক বিজ্ঞান বলে, স্বাস্থ্য বা দীর্ঘায়ুর জন্য দিনে ১০ হাজার কদম হাঁটা বা প্রায় পাঁচ মাইল হাঁটার প্রয়োজন নেই। 

দ্য জার্নাল অব মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনে ২০১৯ সালে প্রকাশিত ডা. আই-মিন লি ও তাঁর সহকর্মীদের গবেষণায় দেখা যায়, সত্তরবর্ষী নারীদের মধ্যে যাঁরা দিনে ৪ হাজার ৪০০ এর মতো কদম হাঁটেন, তাঁদের অকালে মৃত্যুঝুঁকি ২ হাজার ৭০০ বা তারও কম কদম হাঁটা নারীদের তুলনায় ৪০ শতাংশ কম। হাঁটার কদম বাড়ানোর সঙ্গে মৃত্যুঝুঁকিও কমেছে, সাড়ে ৭ হাজার কদম পর্যন্ত একই ফল পাওয়া গেছে। সর্বোপরি গবেষণায় দেখা যায়, যেসব বয়স্ক নারী ১০ হাজারের চেয়ে কম কদম হেঁটেছেন, তাঁরাও দীর্ঘায়ু পেয়েছেন। অর্থাৎ প্রতিদিন ১০ হাজার কদম হাঁটতেই হবে ব্যাপারটি এমন নয়। 

ইউরোপিয়ান জার্নাল অব প্রিভেনটিভ কার্ডিওলজিতে প্রকাশিত গবেষণার বরাত দিয়ে দৈনিক ১০ হাজার কদম হাঁটা প্রয়োজন কি না, এ সম্পর্কে ২০২৩ সালের ৮ আগস্ট একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যম ইউএসএ টুডে। বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের ২ লাখ ৩০ হাজার মানুষের দৈনিক হাঁটা ও কদম গোনার ইতিবাচক প্রভাবের মাত্রা নিয়ে গবেষণাটি করা হয়।

এই গবেষণার অন্যতম লেখক এবং বাল্টিমোরের জনস হপকিন্স ইউনিভার্সিটির মেডিসিনের অধ্যাপক ম্যাকিয়েজ বানাচ ইউএসএ টুডেকে বলেন, হাঁটা থেকে শারীরিকভাবে উপকার পেতে কদমের যে সংখ্যা প্রচার করা হয়, প্রকৃত সংখ্যা তারও কম। তবে কদমের সংখ্যা যত বাড়ে, স্বাস্থ্যগত উপকারও তত বাড়ে। ৬ থেকে ৭ হাজার কদম যারা হাঁটেন, তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে কম মৃত্যুঝুঁকি দেখা গেছে গবেষণায়।

বানাচ বলেন, তাঁর অনেক রোগী নানা কারণে দৈনিক ১০ হাজার কদম হাঁটতে না পারায় হতাশায় ভোগেন। এতটা হাঁটা গবেষণা-সমর্থিত নয়। স্বাস্থ্যগত উপকার, আয়ু বৃদ্ধি ও মৃত্যুঝুঁকি কমানোর জন্য দৈনিক ৪ হাজার থেকে ৫ হাজার কদম হাঁটা যেতে পারে। তিনি তাঁর রোগীদের দৈনিক ৩ থেকে ৪ হাজার কদম হাঁটার পরামর্শ দেন।

যুক্তরাজ্যের শেফিল্ড হালাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রব কোপল্যান্ডের গবেষণার বরাত দিয়ে সংবাদমাধ্যম বিবিসি ২০১৮ সালে ১০ হাজার কদম হাঁটা-সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এই গবেষণায় একদল স্বেচ্ছাসেবককে দুই ভাগে ভাগ করা হয়। এক ভাগ দিনে ১০ হাজার কদম, অর্থাৎ প্রায় পাঁচ মাইল হাঁটে এবং অন্য ভাগ দিনে তিন দফায় মোট তিন হাজার কদম বা দেড় মাইল হাঁটে। তবে তাঁরা হাঁটেন একটু দ্রুত পদক্ষেপে, যাতে তাঁদের হার্ট বা হৃদ্‌যন্ত্রের গতি দ্রুততর হয়। 

গবেষণায় দেখা যায়, যাঁদেরকে ১০ হাজার কদম হাঁটতে বলা হয়েছিল, তাঁদের মধ্যে প্রতি তিনজনের দুজন লক্ষ্য অর্জন করতে পেরেছিলেন। কিন্তু তাঁদের সবারই ১০ হাজার কদম হাঁটতে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। অন্যদিকে যাঁদের তিন হাজার কদম বা দেড় মাইল হাঁটতে বলা হয়েছিল, তাঁদের সবাই বেশ সহজে তাঁদের লক্ষ্য অর্জন করেছেন। রব কোপল্যান্ড গবেষণার ফলাফল থেকে বলেন, যাঁরা দেড় মাইল হেঁটেছিলেন, তাঁরাই আসলে বেশি উপকৃত হচ্ছেন। 

উল্লিখিত আলোচনা থেকে স্পষ্ট, সুস্থ থাকতে দিনে ১০ হাজার কদম হাঁটতেই হবে এমন কোনো চিরায়ত নিয়ম এবং বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। বরং গবেষণায় এর থেকে কম কদম হাঁটাতেও স্বাস্থ্যগত উপকার পাওয়ার তথ্য পাওয়া যায়। হাঁটার সময় কদমের সংখ্যা যত বাড়ে, স্বাস্থ্যগত উপকারও তত বাড়ে। মূলত ১৯৬০ এর দশকে জাপানি পণ্যের বিজ্ঞাপনী প্রচার থেকে দৈনিক ১০ হাজার কদম হাঁটার দাবিটির সূত্রপাত হয়েছে বলে প্রতীয়মান।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, সংবাদমাধ্যম বা যেকোনো মাধ্যমে প্রচারিত কোনো ছবি, ভিডিও বা তথ্য বিভ্রান্তিকর মনে হলে তার স্ক্রিনশট বা লিংক কিংবা সে সম্পর্কিত বিস্তারিত তথ্য আমাদের ই-মেইল করুন। আমাদের ই-মেইল ঠিকানা factcheck@ajkerpatrika.com

কফি পানে মানুষের শারীরিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয়— প্রচলিত ধারণাটি কি বিজ্ঞানসম্মত

লেবু, রসুন, আদা, ভিনেগারের মিশ্রণ খেলে রক্তনালির ব্লকেজ কাটে! চিকিৎসাবিজ্ঞান কী বলে

চর্বি মানেই অস্বাস্থ্যকর? চিকিৎসা বিজ্ঞান কী বলে

নিয়মিত আপেল খেলে ডাক্তারের কাছে যেতে হয় না! চিকিৎসা বিজ্ঞান কী বলে

মাইক্রোস্কোপ ব্যবহার করে ধানের ওপর নকশা— ভাইরাল ছবিটির পেছনের ঘটনা জানুন

সন্তান প্রসবে নারীর ৫৭ ‘ডেল’ ব্যথা অনুভব হয়, যা ২০টি হাড় ভাঙার ব্যথার সমান— দাবিটির সত্যতা জানুন

আক্রান্ত ব্যক্তির সঙ্গে চোখাচোখি হলেই কি চোখ ওঠে, কী বলে চিকিৎসা বিজ্ঞান

আধখণ্ড লেবুতে লবঙ্গ গেঁথে রাখলে মশা পালায়—এই টোটকার বৈজ্ঞানিক ভিত্তি কী

চুইংগাম গিলে ফেললেই বিপদ, পেটে থাকে ৭ বছর! আসলেই কি তাই

করোসল ফল ক্যানসারের প্রতিরোধক, কেমোথেরাপির বিকল্প—এসব দাবি সত্য নয়