গর্ভের সময় নারীর জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলোর একটি। সমাজ ও কালভেদে যুগ যুগ ধরে নারীরা এ সময় প্রয়োজনীয়-অপ্রয়োজনীয় নানা নিয়ম-নীতি মেনে আসছে। এসবের বেড়াজালে কী খাওয়া যাবে আর কী খাওয়া যাবে না, সেই তালিকাও আছে। এ ক্ষেত্রে আনারসের নাম খুব উচ্চারিত হয়। আনারস খেলে গর্ভপাত হয় বলে দাবি করা হয়। আবার আনারস প্রসবের সময়কে এগিয়ে আনে বলেও দাবি করা হয়। তবে বৈজ্ঞানিক গবেষণা বলছে ভিন্ন কথা।
২০১৭ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশি গবেষক ড. মো. মাহবুবুর রহমানের নামে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের জার্নালে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়। সেখানে তিনি লেখেন, মানুষের মধ্যে আনারস নিয়ে দুটি ট্যাবু বা নিষিদ্ধ বিষয় প্রচলিত আছে। ট্যাবু দুটি হলো, দুধ ও আনারস একসঙ্গে না খাওয়া এবং গর্ভকালীন আনারস না খাওয়া। দ্বিতীয় ট্যাবুটি কেবল বাংলাদেশেই নয়, অন্যান্য দেশেও প্রচলিত। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল লাইব্রেরি অব মেডিসিনে প্রকাশিত এক গবেষণা থেকে জানা যায়, ভারতের পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ২৪ পরগনা জেলার ৪৪ জন গর্ভবতী নারী ও স্তন্যদায়ী মায়ের ওপর জরিপ চালানো হয়। এতে দেখা যায়, সেখানেও গর্ভকালীন আনারসসহ আরও বেশ কিছু ফল খাওয়া ট্যাবু হিসেবে প্রচলিত।
তবে স্বাস্থ্যবিষয়ক ওয়েবসাইট হেলথলাইনে বলা হয়েছে, গর্ভকালীন আনারস খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। তবে অতিরিক্ত যেকোনো কিছুর মতোই বেশি বেশি আনারস খাওয়া অস্বস্তিদায়ক উপসর্গ তৈরি করে। কেউ কেউ গর্ভকালীন আনারস খেতে বারণ করেন। তাঁদের দাবি, আনারস গর্ভপাত ঘটায় অথবা প্রসবের সময়কে এগিয়ে নিয়ে আসে। তবে এটা শুধুই প্রচলিত ধারণা। গর্ভকালীন আনারস খাওয়া ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ার দাবির কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই।
২০২২ সালের জুনে গর্ভপাতের অধিকার দেওয়া প্রায় পাঁচ দশকের একটি পুরোনো আইন বাতিল করে দেন যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্ট। আদেশে বলা হয়, অঙ্গরাজ্যগুলো নিজেদের সিদ্ধান্ত মোতাবেক গর্ভপাতের অনুমতি প্রদান অথবা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে আইন করতে পারে। এ ঘটনার পর নেটিজেনরা ঘরে বসেই গর্ভপাত ঘটানোর বিভিন্ন কৌশল সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়াতে থাকে। এসব কৌশলের মধ্যে ছিল আনারসের জুসের ব্যবহার। এসব দাবি নিয়ে ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন প্রকাশ করে বার্তা সংস্থা এপি। প্রতিষ্ঠানটি বিভিন্ন বিশেষজ্ঞের বরাত দিয়ে জানায়, আনারসের জুস গর্ভপাত ঘটায় না।
এ প্রসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটি স্কুল অব মেডিসিনের প্রসূতি ও গাইনোকোলজির অধ্যাপক ডা. রুথ লাথি এপিকে বলেন, গর্ভপাত ঘটাতে পারে বা গর্ভপাত ঘটানোর জন্য সহায়ক কোনো ঘরোয়া পন্থা নেই।
তাহলে এমন মিথ বা ধারণা কীভাবে জন্মাল? ওয়েবএমডি বলছে, আনারস নিয়ে এ ধারণা জন্মানোর একটি কারণ হলো, এর মধ্যে থাকা ব্রোমেলেন এনজাইম। কথিত আছে, ব্রোমেলেন জরায়ুর সংকোচন ঘটায়। তবে এ প্রসঙ্গে মানুষের ওপর কোনো গবেষণা করা হয়নি বরং অন্য প্রাণীর ওপর গবেষণা করা হয়েছে। এতে দেখা যায়, প্রাণীর জরায়ুতে সরাসরি ব্রোমেলেন প্রয়োগ করা হলেই কেবল এর সংকোচন ঘটে, এর সঙ্গে প্রসবের কোনো সম্পর্ক নেই।
গর্ভকালীন আনারস খাওয়া গর্ভবতী নারীর কোনো ক্ষতি করে না উল্লেখ করে স্বাস্থ্যবিষয়ক ম্যাগাজিন মেডিকেল নিউজ টুডে জানায়, মানুষের মধ্যে গর্ভপাত ও প্রসবকে ত্বরান্বিত করার বিষয়ে বিভিন্ন ধারণা প্রচলিত আছে। সেগুলোর কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই।
ফিলিপাইনের চিকিৎসকের সংগঠন হ্যালো ডক্টরসও জানায়, গর্ভপাত বা প্রসব ত্বরান্বিত করার সঙ্গে আনারস বা এর মধ্যে থাকা এনজাইম ব্রোমেলেনের সম্পৃক্ততার কোনো বৈজ্ঞানিক প্রমাণ নেই। তবে ব্যথানাশক ও শরীর ফোলা কমাতে সাপ্লিমেন্ট হিসেবে বাজারে ব্রোমেলেন ট্যাবলেট পাওয়া যায়। এ ধরনের ট্যাবলেট বা সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দিয়েছে হ্যালো ডক্টরস।