হোম > ফ্যাক্টচেক > জানি, কিন্তু ভুল

রসুন খেলে কি মশা কামড়ায় না

ফ্যাক্টচেক  ডেস্ক

মশা কমবেশি সবার কাছেই একই সঙ্গে আতঙ্ক ও বিরক্তির কারণ। ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়াসহ নানা রোগের ভাইরাস বহন করে এরা। তাই এদের কামড় থেকে বাঁচতে যুগ যুগ ধরেই বিভিন্ন ঘরোয়া প্রতিকার ব্যবহার হয়ে আসছে। এসব প্রতিকারের একটি রসুন খাওয়া। দাবি করা হয়, মশা তাড়াতে রসুনের জুড়ি নেই। রসুনে অ্যালিসিন নামে এক ধরনের উপাদান থাকে। রসুন খেলে শরীরের লোমকূপ দিয়ে অ্যালিসিন বের হয়। ফলে মশা শরীরে বসে না। রসুন খেলে কি আসলেই মশা কামড়ায় না? বিশেষজ্ঞরা কি বলছেন? 

রসুন খাওয়া মশা তাড়াতে পারে কি না তা নিয়ে ২০০৫ সালে একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব কানেকটিকাট হেলথ সেন্টার। গবেষণাটি করা হয় ২১ থেকে ৭৫ বছর বয়সী ৫১ জন ব্যক্তির ওপর। তাদেরকে রসুন ও প্লেসবো (গবেষণায় ব্যবহৃত পদার্থ) খেতে বলা হয় এবং পরে পরীক্ষাগারে পালিত মশার সংস্পর্শে আনা হয়। এই গবেষণার বরাত দিয়ে দেশটির সংবাদমাধ্যম নিউ ইয়র্ক টাইমস ২০০৭ সালে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানায়, রসুন খাওয়ার সঙ্গে মশার কামড় এড়ানোর কোনো সম্পর্ক পাওয়া যায়নি। যদিও গবেষণাটিতে বলা হয়, এর একটি সীমাবদ্ধতা হল, এখানে নমুনা হিসেবে নেওয়া ব্যক্তিদের কম সময় রসুন খাওয়ানো হয়েছে। কাঙ্ক্ষিত ফলাফল পেতে আরও দীর্ঘ সময় রসুন খাওয়ার প্রয়োজন হতে পারে।

আমেরিকান মশা নিয়ন্ত্রণ অ্যাসোসিয়েশনের প্রযুক্তি উপদেষ্টা ও মার্কিন নৌবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কীটতত্ত্ববিদ জোসেফ এম. কনলন যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যম সিএনএনকে বলেন, একজন ব্যক্তি যা-ই খান না কেন, তা মশাকে এত বেশি প্রভাবিত করে না। বরং যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টারস ফর ডিজিজ কন্ট্রোলের প্রধান কীটতত্ত্ব গবেষক হ্যারি স্যাভেজ সিএনএনকে বলেন, মশাকে সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ করে কার্বন ডাই অক্সাইড এবং তাপ। ঘ্রাণও এ ক্ষেত্রে একটি ভূমিকা পালন করতে পারে। ব্যক্তির শরীর থেকে নির্গত ঘাম এবং অন্যান্য উপাদানও একজন ব্যক্তিকে অন্য একজনের চেয়ে মশার কাছে আরও আকর্ষণীয় করে তুলতে পারে। অর্থাৎ রসুন খাওয়া মশার কামড় এড়াতে সাহায্য করে এই দাবির পক্ষে তেমন ভিত্তি নেই।

জোসেফ এম. কনলন দেশটির আরেকটি সংবাদমাধ্যম এবিসি নিউজ গোকে বলেন, রসুন খাওয়া মশার কামড় এড়াতে প্রতিষেধক হিসেবে কাজ করে-এটি একটি মিথ বা প্রচলিত ভুল ধারণা। তবে এর কিছুটা সত্যতাও আছে। কেউ যদি ত্বকে রসুন ঘষে, তাহলে ত্বকের ওই নির্দিষ্ট অংশ প্রায় ২০ থেকে ৪০ মিনিট মশা প্রতিরোধক হিসেবে কাজ করে। 

স্বাস্থ্য বিষয়ক ম্যাগাজিন মেডিকেল নিউজ টুডেও জানায়, রসুনের ঘ্রাণ মানুষের প্রতি মশার আকর্ষণ কমাতে পারে। গবেষণায় দেখা যায়, রসুনের তেল প্রয়োগের প্রথম 30 মিনিটের জন্য একটি শক্তিশালী মশা নিরোধক হিসেবে কাজ করে, কিন্তু এই সময়ের পরে এটি দুর্বল হয়ে যায়। কিছু লোক মশাকে দূরে রাখতে রসুনের ট্যাবলেট গ্রহণ করে, কিন্তু এর কার্যকারিতার পক্ষে খুব বেশি প্রমাণ পাওয়া যায় না। 

রসুন খাওয়ার সঙ্গে মশার কামড়ের সম্পর্ক নিয়ে ইংল্যান্ডের অ্যাংলিয়া রাসকিন বিশ্ববিদ্যালয়ের জনস্বাস্থ্যের তৎকালীন সিনিয়র লেকচারার তাবিথা মাওয়াংগি অস্ট্রেলিয়ার সংবাদমাধ্যম দ্য কনভারসেশনে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। এতে তিনি লেখেন, রসুন খাওয়া মশার কামড় থেকে বাঁচতে প্রতিষেধক হিসেবে কাজ করে-এমন দাবিটির কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। রসুন অ্যালিসিন নামে এক ধরনের সালফার জাতীয় উপাদান তৈরি করে। যা কিছুটা ব্যাকটেরিয়াল, ফাঙ্গাল এবং পরজীবী প্রতিরোধক হিসেবে কাজ করে। গবেষকেরা ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত ইঁদুরের ওপর এর প্রভাব দেখেছেন। ইঁদুরের ক্ষেত্রে, অ্যালিসিনের ব্যবহার রক্তে ম্যালেরিয়া পরজীবীর সংখ্যা হ্রাস করে, অ্যালিসিনের মাত্রা যত বেশি হয়, ইঁদুর তত বেশি সময় বেঁচে থাকে। কিন্তু মানুষের রোগ প্রতিরোধে প্রভাব নিয়ে কোনো গবেষণা করা হয়নি।

কানাডার ক্যালগারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ববিদ জন সোয়ান দেশটির সংবাদমাধ্যম সিবিসিকে একই প্রসঙ্গে বলেন, মশার কামড় থেকে বাঁচতে আপনি যত খুশি রসুন খেতে পারেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এটি আপনার থেকে মশাকে দূরে রাখবে না। রসুন একমাত্র যা করতে পারে, আপনার বন্ধু-বান্ধব এবং পরিবারকে আপনার থেকে দূরে সরিয়ে দেবে। বিজ্ঞান এখন পর্যন্ত এমন কিছু নিশ্চিত করেনি যে, আপনি যা খান তা আপনাকে পোকামাকড়ের প্রতি কম বা বেশি আকর্ষণীয় করে তুলতে পারে। কিন্তু গবেষকেরা জানেন, মশারা মানুষ থেকে নির্গত কিছু নির্দিষ্ট রাসায়নিকের প্রতি বেশি আকৃষ্ট হয়।

সিঙ্গাপুরের গ্লেনেয়াগ্লেস হসপিটাল জানায়, রসুন খাওয়া মশা দূরে রাখে- এই দাবির পক্ষে কোনো বৈজ্ঞানিক  প্রমাণ নেই। মশা সাধারণত ওই ব্যক্তিদের প্রতি বেশি আকৃষ্ট হয়, যারা বেশি মাত্রায় কার্বন ডাই অক্সাইড নিঃসরণ করে। মানুষের শরীরের আকার যত বড় হয়, ওই ব্যক্তি তত বেশি কার্বন ডাই অক্সাইড নিঃসরণ করবে। এই কারণেই মশা শিশুদের চেয়ে গর্ভবতী নারীদের বেশি কামড়ায়।  ঘাম, শরীরের উচ্চ তাপমাত্রা এবং পারফিউমও মশাকে আকৃষ্ট করতে পারে। 

উল্লিখিত আলোচনা থেকে স্পষ্ট, রসুন খাওয়ার সঙ্গে মশার কামড় এড়ানোর কোনো সম্পর্ক নেই। বৈজ্ঞানিক গবেষণা দাবিটিকে সমর্থন করে না। এটি প্রচলিত ভুল ধারণা মাত্র।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, সংবাদমাধ্যম বা যেকোনো মাধ্যমে প্রচারিত কোনো ছবি, ভিডিও বা তথ্য বিভ্রান্তিকর মনে হলে তার স্ক্রিনশট বা লিংক কিংবা সে সম্পর্কিত বিস্তারিত তথ্য আমাদের ই-মেইল করুন। আমাদের ই-মেইল ঠিকানা factcheck@ajkerpatrika.com

সন্তান প্রসবে নারীর ৫৭ ‘ডেল’ ব্যথা অনুভব হয়, যা ২০টি হাড় ভাঙার ব্যথার সমান— দাবিটির সত্যতা জানুন

আক্রান্ত ব্যক্তির সঙ্গে চোখাচোখি হলেই কি চোখ ওঠে, কী বলে চিকিৎসা বিজ্ঞান

আধখণ্ড লেবুতে লবঙ্গ গেঁথে রাখলে মশা পালায়—এই টোটকার বৈজ্ঞানিক ভিত্তি কী

চুইংগাম গিলে ফেললেই বিপদ, পেটে থাকে ৭ বছর! আসলেই কি তাই

করোসল ফল ক্যানসারের প্রতিরোধক, কেমোথেরাপির বিকল্প—এসব দাবি সত্য নয়

পানি কি মেয়াদোত্তীর্ণ হয়, বোতলে কিসের মেয়াদ

রোম যখন পুড়ছিল, সম্রাট নিরো তখন আসলেই বাঁশি বাজাচ্ছিলেন?

শসা খেলে কিডনির পাথর গলে, বিশেষজ্ঞরা বলছেন সত্যতা নেই

কুকুরের পেটে সত্যি কি ঘি হজম হয় না, কী বলছেন পশুচিকিৎসকেরা

দাঁতে কি আসলেই পোকা হয়? এ ধারণার উৎপত্তি কীভাবে, বিজ্ঞান কী বলে

সেকশন