‘ভাইরাস’ লাতিন শব্দ, অর্থ হচ্ছে ‘বিষ’। আজ আর এ শব্দ কারও কাছে অপরিচিত নয়। রহস্যময় এই ভাইরাস জীবন্ত নয়, আবার একে মৃতও বলা যাবে না। জীবন্ত জীবকোষে প্রবেশের পরই সে সংখ্যাবৃদ্ধি করতে সক্ষম হয় ও সংক্রামক হয়ে উঠতে পারে। তা না হলে জড় বস্তুর সঙ্গে এর কোনো পার্থক্য নেই। আজ পর্যন্ত যেকোনো ধরনের, আকারের ভাইরাসকে কেউই খালি চোখে দেখতে সক্ষম হয়নি, ভবিষ্যতেও তা কেউ পারবে না। কারণ অকোষী ভাইরাস অতিক্ষুদ্র।
তবে কেউ কেউ আমাদের বাংলাদেশের ভোলার অধিবাসী রহিমা বানুকে দেখেছেন, তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন। তার পরও অনেকেরই জানা নেই চমকপ্রদ এক ইতিহাস। তাঁর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার আগে ভাইরাস নিয়ে আরেকটু বলা মোটেই বাহুল্য হবে না।
মানব ইতিহাসের আদি থেকেই মানুষের সঙ্গে আছে ভাইরাসজনিত ব্যাধি, সাধারণ ঠান্ডা-সর্দি জ্বর থেকে শুরু করে জলাতঙ্ক, গুটিবসন্ত, জন্ডিস, ডেঙ্গু, পোলিওমাইলিটিস, ফ্লু, হাম, রোটাভাইরাস ডায়রিয়া, এইডস, ইবোলা, মাম্পস ইত্যাদি। মানুষের দুর্দশার এ তালিকার এখানেই শেষ নয়। তা ছাড়া বর্তমানে আতঙ্ক বেড়েছে করোনাভাইরাসের কারণে। এটি ইতিমধ্যে কেড়ে নিয়েছে ৪০ লাখের বেশি মানুষের জীবন। তারপরও মৃত্যুর মিছিল থামছে না। এখন একমাত্র টিকাই হতে পারে রক্ষাকবচ।
তবে এই টিকাও নতুন নয়। মারাত্মক সংক্রামক ব্যাধি গুটিবসন্তের ভয়াবহতা অনেকেরই মনে থাকার কথা। বহু শতাব্দী ধরে গুটিবসন্ত ছিল এক বিশাল ত্রাসের নাম। এই রোগের ভাইরাসের নাম ভ্যারিওলা মেজর। একবার সংক্রামিত হলে উজাড় হয়ে যেত লোকালয়।
সরগরম জনবসতি পরিণত হতো মৃত নগরীতে, শবদেহের সৎকারের জন্যও কাউকে খুঁজে পাওয়া সহজ হতো না। শুধু বিশ শতকেই গুটিবসন্তে প্রাণ হারিয়েছেন প্রায় ৩০ কোটি মানুষ। এতে আক্রান্ত হলে প্রতি ১০০ জনে ৩০ জনের মৃত্যু হতো। শিশুমৃত্যুর হার ৮০ শতাংশ ছাড়িয়ে যেত। যাঁরা বেঁচে যেতেন, তাঁদের অনেকেই আবার অন্ধ হয়ে যেতেন এবং সারা জীবন শরীরে অস্বস্তিকর স্থায়ী দাগ বয়ে বেড়াতেন। আজ এই ভয়ংকর রোগটি আশ্রয় নিয়েছে ইতিহাসের পাতায়।
ব্রিটিশ চিকিৎসক অ্যাডওয়ার্ড জেনার লক্ষ করছিলেন, গোবসন্তে আক্রান্ত ব্যক্তিরা, বিশেষ করে গোয়ালিনীরা গুটিবসন্তে আক্রান্ত হন না। আজ থেকে ২২৫ বছর আগের ঘটনা। তারিখ ১৪ মে ১৭৯৬। এ দিন সারা নেলমস নামের এক তরুণীর হাতের গোবসন্তের তাজা গুটি থেকে খানিকটা তরল নিয়ে ৮ বছরের বালক জেমস ফিপসের শরীরে প্রবেশ করান ডা. অ্যাডওয়ার্ড জেনার। এরপর তিনি লক্ষ করলেন, বালকটির শরীর ধীরে ধীরে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। তিনি নিশ্চিত হলেন, অমূল্য মহৌষধের সন্ধান পেয়েছেন। জন্ম নিল ‘টিকা’ বা ‘ভ্যাকসিন’। ইতিহাসের পাতায় নাম লেখালেন একজন মহামানব—তাঁকে বলা হলো ‘ইমিউনোলজির জনক’। ডা. অ্যাডওয়ার্ড জেনারের এমন যুগান্তকরী আবিষ্কারের পথ ধরেই পৃথিবী থেকে গুটিবসন্ত নির্মূল করা সম্ভব হয়েছে, রক্ষা পেয়েছে কোটি কোটি মানুষের প্রাণ।
মজার ব্যাপার হলো, সংক্রামক রোগের সঙ্গে ভাইরাস ও অণুজীবের মাখামাখি সম্পর্ক আছে। বর্তমানে সে খবর জানা থাকলেও ১৭৯৬ সালে গুটিবসন্তের টিকার উদ্ভাবক অ্যাডওয়ার্ড জেনার এবং ১৮৮৫ সালে জলাতঙ্ক রোগের টিকার উদ্ভাবক ফরাসি বিজ্ঞানী লুই পাস্তুর, তাঁরা দুজনই ভাইরাস সম্পর্কে তেমন কিছু জানতেন না।
স্বাস্থ্য কর্মকর্তা জানতে পারেন, সেখানকার কুরালিয়া গ্রামের তিন বছর বয়সী রহিমা বানু নামের একটি শিশু গুটিবসন্তে আক্রান্ত হয়েছে। বাংলাদেশ থেকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সদর দপ্তরে জরুরি টেলিগ্রামে রহিমা বানুর খবর পৌঁছে দেওয়া হয় গুটিবসন্ত নির্মূল কার্যক্রমের প্রধান ডি এ হেন্ডারসনের কাছে।
খবর পাওয়ার পর দ্রুততম সময়ে তাঁর দলবল নিয়ে হেন্ডারসন সরাসরি ভোলায় হাজির হন এবং সঙ্গে সঙ্গে রহিমা বানুকে আলাদা করে ফেলেন অন্যদের কাছ থেকে। ২৪ নভেম্বর ১৯৭৫ রহিমা বানু সম্পূর্ণরূপে সুস্থ হয়ে ওঠে। দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ায় তাকে বাঁচানো সম্ভব হয়েছিল।
রহিমা বানু ছিলেন বিশ্বের সর্বশেষ মানুষ, যিনি এই অভিশপ্ত রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন। তাঁর গুটিবসন্তে আক্রান্ত হওয়ার খবরটি স্বাস্থ্য কর্মকর্তার কাছে সময়মতো পৌঁছে দিয়েছিল আট বছরের মেয়ে বিলকিসুন্নেসা। এ জন্য সে সময় তাঁকে ২৫০ টাকা পুরস্কারও দেওয়া হয়েছিল।
১৯৭৬ সালের ২ জানুয়ারি বাংলাদেশকে গুটিবসন্তমুক্ত দেশ ঘোষণা করা হয়। অ্যাডওয়ার্ড জেনারের বিস্ময়কর টিকা আবিষ্কারের প্রায় ২০০ বছর পর, ৮ মে ১৯৮০ ওয়ার্ল্ড হেলথ অ্যাসেমব্লি আনুষ্ঠানিকভাবে এই প্রাণঘাতী দানবকে চিরতরে নির্মূল ঘোষণা করে।
যুক্তরাষ্ট্রের রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্রের (সিডিসি) গবেষণাগারে রহিমা বানুর দেহ থেকে নেওয়া গুটিবসন্তের ভাইরাস আজও সংরক্ষিত আছে। নাম দেওয়া হয়েছে ‘বাংলাদেশ ১৯৭৫’ বা ‘রহিমা স্ট্রেইন’।
রহিমা বানুর শেষ খবর যেটুকু পাওয়া যায়, তাতে জানা যায়, তিনি বর্তমানে বিবাহিত এবং চার সন্তানের জননী। সে যা-ই হোক, বাংলাদেশের রহিমা বানুর হাত ধরে অতিমারির ইতিহাসের একটি বিষণ্ন এবং কালো অধ্যায়ের ইতি ঘটেছে। নিজের অজান্তেই তিনি একটি চমৎকার ইতিহাসের অংশ হয়ে গেছেন।
মইনুল হাসান: ফ্রান্স প্রবাসী লেখক ও গবেষক