গত বছরের জুলাই মাসে কেনিয়ার রাজধানী নাইরোবিতে সরকারবিরোধী বিক্ষোভ চলাকালীন পুলিশের গুলিতে নিহত হন ১৯ বছর বয়সী চার্লস ওউইনো। কিন্তু পুলিশ এই ঘটনাকে ‘সড়ক দুর্ঘটনা’ হিসেবে নথিভুক্ত করেছে বলে অভিযোগ করেছেন তাঁর ভাই। বার্তা সংস্থা রয়টার্স ওই ঘটনার ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন জোগাড় করেছে। প্রতিবেদনে ওউইনোর মৃত্যুর কারণ হিসেবে মাথায় গুলির আঘাতের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
একই দিন কিতেঙ্গেলা এলাকার আরও এক বিক্ষোভকারী, ২১ বছর বয়সী শাকিল ওবিয়েঞ্জের মৃত্যু ঘটে। তাঁর পরিবার জানিয়েছে, পুলিশ এই মৃত্যুকেও সড়ক দুর্ঘটনা হিসেবে উল্লেখ করেছে। কিন্তু ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তাঁর মৃত্যু গলার কাছ থেকে গুলির আঘাতে হয়েছে।
কেনিয়ায় গত বছর জুনের শেষ দিকে কর বৃদ্ধির বিরুদ্ধে এবং রাজনৈতিক নেতাদের দুর্নীতির প্রতিবাদে হাজার হাজার তরুণ সারা দেশে রাস্তায় নেমে আসেন। এই বিক্ষোভ প্রতিবাদগুলো তখন ‘জেন জি প্রতিবাদ’ নামে পরিচিত হয়ে ওঠে।
সরকার কঠোরহস্তের সেই বিক্ষোভ দমন করে। কেনিয়ার ভাইস প্রেসিডেন্ট কিথুরে কিন্ডিকি বলেছেন, পুলিশের অ্যাকশনে ৪২ জন নিহত হয়েছে। অধিকার সংগঠনগুলো বলছে, পুলিশ বিক্ষোভকারীদের সরাসরি গুলি করেছে।
বেশ কিছু মানবাধিকার সংগঠন অভিযোগ করেছে, সরকার পুলিশের দ্বারা সংঘটিত বেশ কিছু হত্যাকাণ্ড, অপহরণ, গুম এবং অবৈধ আটক ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেছে।
কেনিয়ার রাষ্ট্রীয় তহবিলে পরিচালিত জাতীয় মানবাধিকার কমিশন জুন থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত এই বিক্ষোভ প্রতিবাদের সময় ৮২টি গুমের ঘটনা নথিভুক্ত করেছে, যেখানে পূর্ববর্তী ১৮ মাসে এই সংখ্যা ছিল মাত্র ৯টি। এর মধ্যে ২৯ জন এখনো নিখোঁজ রয়েছেন বলে গত ২৬ ডিসেম্বর এক বিবৃতিতে জানিয়েছে কমিশন।
পুলিশের দাবি এবং বাস্তবতা
পুলিশ কর্মকর্তাদের বরাতে রয়টার্স জানতে পেরেছে, বিক্ষোভে পুলিশের হাতে নিহত ব্যক্তিদের মৃত্যু প্রায়ই ‘সড়ক দুর্ঘটনা’, ‘গণপিটুনি’ বা ‘পানিতে ডুবে মৃত্যু’ বলে উল্লেখ করা হয়। রয়টার্স চারজন বিক্ষোভকারীর মৃত্যুর ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখেছে, তাঁদের মৃত্যুর প্রকৃত কারণ এবং পুলিশের নথিভুক্ত তথ্যের মধ্যে বড় ধরনের অমিল রয়েছে।
ওউইনোর মৃত্যুর সময় তাঁর দেহের পাশে রক্ত ছড়িয়ে থাকা রাস্তা এবং এক পুলিশ কর্মকর্তার রাইফেল হাতে দাঁড়িয়ে থাকা ছবি রয়টার্সের কাছে এসেছে। পুলিশ এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেনি।
মর্গের নথি এবং ময়নাতদন্তের পার্থক্য
নাইরোবির সবচেয়ে ব্যস্ত সরকারি মর্গ হলো নাইরোবি ফিউনারাল হোম। এই মর্গের তিন মাসের নথি পর্যালোচনায় দেখা গেছে, বিক্ষোভ চলাকালীন পুলিশের নথিভুক্ত ৯৪টি মৃত্যুর কারণ গণপিটুনি বা পানিতে ডুবে মৃত্যু হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। আর গুলির আঘাতে মৃত্যুর সংখ্যা মাত্র ৯টি। অথচ আগের বছর একই সময়ে গুলির আঘাতে মৃত্যুর সংখ্যা ছিল দ্বিগুণের বেশি।
অপারেশন অ্যাকশন টিম (ওএটি)
কেনিয়ার পুলিশের একটি বিশেষ ইউনিট অপারেশন অ্যাকশন টিম (ওএটি)। বিক্ষোভ দমনে এই বিশেষ টিমকে ব্যবহার করা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) জানিয়েছে, ২০১৯ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে পুলিশের বিশেষ ইউনিটগুলোর মাধ্যমে ৫০০টির বেশি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও অজানা কারণে নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা ঘটেছে।
নিখোঁজ বিক্ষোভকারী ও পুলিশের ভূমিকা
নাইরোবির শহরতলির একটি পরিত্যক্ত খনির পুকুরে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ওমন্ডির মৃতদেহ পাওয়া যায়। তাঁর বাবা জেমস ওতিয়েনো মৃতদেহ শনাক্ত করার পর একজন সরকারি প্যাথলজিস্টের দ্বারা প্রস্তুত করা ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, তাঁর ফুসফুস অস্বাভাবিক স্ফীত ছিল এবং মাথা, গলা, ডান হাতের কনুই এবং হাঁটুতে আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে।
ওতিয়েনো রয়টার্সকে বলেন, ডুবে যাওয়ার আগে অন্য কিছু ঘটেছিল। ৫৫ বছর বয়সী ওতিয়েনোর ব্যক্তিগত নিরাপত্তা কর্মকর্তা হিসেবে এসব ঘটনার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা রয়েছে। তাঁর মনে নানা প্রশ্ন। কিন্তু কর্তৃপক্ষ কোনো প্রশ্নের জবাব দিতে নারাজ।
কেনিয়ার জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, জুন থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ৮২টি গুমের ঘটনা নথিভুক্ত হয়েছে। এর মধ্যে ২৯ জনের এখনো খোঁজ মেলেনি। সাতজন ভুক্তভোগীর পরিবার রয়টার্সকে জানিয়েছে, তাঁরা সরাসরি পুলিশের সঙ্গে এই ঘটনার সম্পর্ক খুঁজে পেয়েছেন।
নির্যাতনের অভিজ্ঞতা
আইনের ছাত্র জোশুয়া ওকায়ো জানিয়েছেন, তাঁকে রাস্তা থেকে ধরে নিয়ে গিয়ে লোহার রড দিয়ে পেটানো হয়েছে। নির্যাতনের সময় বারবার বিক্ষোভে অংশ নেওয়ার কারণ জিজ্ঞেস করা হয়। দুই দিন পর তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়। জোশুয়া বলেছেন, ছেড়ে দেওয়ার আগে তাঁকে বিক্ষোভকারীদের ব্যাপারে তথ্য সরবরাহ করে পুলিশের সঙ্গে কাজ করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল।
সরকারি প্রতিক্রিয়া
কেনিয়ার প্রেসিডেন্ট উইলিয়াম রুটো এক ভাষণে স্বীকার করেন, কিছু ক্ষেত্রে পুলিশ সদস্যদের দ্বারা অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ এবং বিচারবহির্ভূত কার্যকলাপ ঘটেছে। তবে পুলিশের পক্ষ থেকে এই অভিযোগগুলোর কোনো আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া এখনো আসেনি।
তবে ডেপুটি প্রেসিডেন্ট কিথুরে কিন্ডিকি ‘কিছু জীবন পুলিশি অ্যাকশনে হারিয়ে গেছে’ বলে স্বীকার করলেও পুলিশকে দায়মুক্তি দিয়ে বলেছেন, ‘তবে ব্যতিক্রমী পরিস্থিতিতে প্রাণঘাতী বলপ্রয়োগ অনুমোদিত।’