আজকাল সুস্থ ও সচেতন জীবনযাপনের ক্ষেত্রে ‘মাইন্ডফুলনেস’ ধারণাটি ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। হোটেল, স্পা এবং আধ্যাত্মিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলো এখন এই ধারণার প্রচার ও প্রসারে ব্যস্ত। তবে হিমালয়-কন্যা ভুটান আরও একধাপ এগিয়ে যাচ্ছে—তারা গড়ে তুলছে একটি সম্পূর্ণ মাইন্ডফুলনেস শহর!
শুক্রবার সিএনএন জানিয়েছে, ভারতের সীমান্তের কাছাকাছি ভুটানের দক্ষিণাঞ্চলীয় ওই শহরটির নাম গেলেপু। এত দিন পর্যন্ত ব্যতিক্রমী এই প্রকল্প সম্পর্কে খুব বেশি তথ্য জানা যায়নি। তবে সম্প্রতি ‘বিয়ার্ক ইনগেলস গ্রুপ’ (বিগ) নামের একটি স্থাপত্য প্রতিষ্ঠান গেলেপু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নকশা উন্মোচন করেছে, যা এই মাইন্ডফুলনেস শহরের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে একটি প্রথম পরিষ্কার ধারণা দিয়েছে।
বিমানবন্দরটির স্থাপত্য নকশায় দেখা যাচ্ছে—কাঠ দিয়ে একাধিক হিরার মতো অবকাঠামো তৈরি করা হয়েছে। এই অবকাঠামো নির্মাণে ব্যবহৃত হয়েছে স্থানান্তরযোগ্য ‘মডুলার প্রযুক্তি’। ফলে ভবিষ্যতে বিমানবন্দরটির সম্প্রসারণ বা উন্নয়ন করা সহজ হবে।
বিমানবন্দরে সাধারণত ফ্লাইট বিলম্ব, দীর্ঘ লাইন এবং লাগেজ হারানোর মতো বিষয়গুলো ভ্রমণকারীদের চাপ এবং উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তাই প্রশ্ন উঠতে পারে—একটি বিমানবন্দর কীভাবে মাইন্ডফুলনেস ধারণাকে ধারণ করছে?
এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া গেছে বিমানবন্দরটির স্থপতি প্রতিষ্ঠান ইনগেলসের বিবৃতিতে। সংস্থাটির মতে, এর উত্তর রয়েছে বিমানবন্দর নির্মাণে প্রাকৃতিক উপাদান ব্যবহারে এবং সুখের ভিত্তিতে ভুটানের সমৃদ্ধি পরিমাপ করার দর্শনের প্রতিফলনে।
ইনগেলসের বিবৃতে বলা হয়েছে, ‘একটি বিমানবন্দর কোনো স্থানের শুরু ও শেষ চিহ্ন তৈরি করে। তাই আমরা এমন একটি নকশা করেছি, যেখানে স্থাপত্য কাঠামো পাহাড়ের মতো দেখাবে এবং এটি স্থানীয় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে ধারণ করবে।’
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো—এই বিমানবন্দর সম্পূর্ণভাবে কার্বন-নেগেটিভ হবে এবং বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য ছাদে সৌর প্যানেল স্থাপন করা হবে। বিমানবন্দরটির আয়তন হবে ৭ লাখ ৩১ হাজার ৯৪৬ বর্গফুট, যেখানে প্রতিদিন ১২৩টি ফ্লাইট পরিচালনা করা সম্ভব হবে এবং বছরে ১৩ লাখ যাত্রী পরিবহন করা যাবে।
বিশ্বের বড় বড় বিমানবন্দরের তুলনায় এটিকে ছোট মনে হলেও, ভুটানের মতো একটি ক্ষুদ্র দেশের জন্য এটি অনেক বড় একটি পদক্ষেপ। ২০১৯ সালে দেশটিতে মাত্র ৩ লাক ১৬ হাজার পর্যটক ভ্রমণ করেছিলেন। দেশটিতে প্রবেশের জন্য বর্তমানে বিদেশি পর্যটকদের ‘পারো আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর’ ব্যবহার করতে হয়, যা রাজধানী থিম্পুর কাছাকাছি অবস্থিত। পারো বিমানবন্দরটি দুইটি হিমালয় পর্বতের মাঝে অবস্থিত হওয়ায় এটি পরিচালনা করা অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং। এখানে শুধুমাত্র ছোট আকারের উড়োজাহাজ পরিচালিত হয় এবং প্রধানত এশিয়ার কয়েকটি শহর, যেমন নয়াদিল্লি ও ব্যাংককের সঙ্গে এটি সংযুক্ত রয়েছে।
গেলেপু শহরে ইতিমধ্যে একটি ছোট দেশীয় বিমানবন্দর রয়েছে। তবে নতুন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের জন্য এই অঞ্চলকেই বেছে নেওয়া হয়েছে। কারণ সমতল ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্যের কারণে সেখানে দীর্ঘ রানওয়ে নির্মাণ করা সম্ভব হবে এবং বড় উড়োজাহাজ পরিচালনা করা যাবে।
এ ছাড়াও গেলেপুর অবস্থান ভারতের কাছাকাছি হওয়ায় এটি ভুটানের কৌশলগত বাণিজ্যিক ও কূটনৈতিক কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠবে। এখানে রেল ও সড়ক যোগাযোগ উন্নয়নেরও পরিকল্পনা রয়েছে।
ভুটানের রাজা জিগমে খেসার নামগেল ওয়াংচুক এই প্রকল্পের মূল চালিকা শক্তি। তিনি বলেন, ‘এই বিমানবন্দর গেলেপু মাইন্ডফুলনেস সিটি (জিএমসি) প্রকল্পকে সফল করতে অপরিহার্য। পাশাপাশি এটি ভুটানের জাতীয় নিরাপত্তার জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।’
প্রায় সাড়ে ৭ লাখ জনসংখ্যার দেশ ভুটান টেকসই পর্যটনের ক্ষেত্রে বিশ্বে পথিকৃৎ। দেশটিতে বিদেশি পর্যটকদের জন্য প্রতিদিন ১০০ ডলার ‘সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট ফি’ নির্ধারিত রয়েছে, যা স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা ও অন্যান্য সরকারি সেবার উন্নয়নে ব্যবহৃত হয়।
গেলেপু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর উদ্বোধনের তারিখ এখনো ঘোষণা করা হয়নি। তবে এটি চালু হলে ভুটানের পর্যটন এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে ব্যাপক ইতিবাচক পরিবর্তন আনবে।