দুটি লাশই বিকৃত হয়ে গেছে। পাশাপাশি রাখা হয়েছে মর্গে। লাশের গন্ধ ঢাকতে যে ওষুধ ছিটানো হয়েছে, তার গন্ধেও গা গুলিয়ে আসে। এর মাঝেই লাশ দুটির মুখের ওপর ঝুঁকে আছেন এক দন্তচিকিৎসক। মাথা উঁচিয়ে বললেন, হ্যাঁ, তাঁরা দুজনই। ময়নাতদন্ত করা প্যাথলজিস্ট জানালেন, মেয়েটির মাথায় ভারী কিছু দিয়ে আঘাত করা হয়েছিল, আর ছেলেটিকে শ্বাসরোধ। আর শরীরে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার সময়ও তাঁরা জীবিতই ছিলেন।
১৯৭৬ সালের ৩ মার্চ থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককের ওই মর্গের স্মৃতি এখনো স্পষ্ট মনে আছে ডাচ কূটনীতিক হারম্যান নিপেনবার্গের। ৩০ বছরের চাকরি জীবনে এমন বিভীষিকাময় দৃশ্য তিনি আর কখনোই দেখেননি। এর জন্য দায়ী ব্যক্তিকে খুঁজে বিচারের মুখোমুখি করতে পরবর্তী এক দশকেরও বেশি সময় কেটে যায় তাঁর। কারণ, ছেলে-মেয়ে দুটি তাঁর দেশ নেদারল্যান্ড থেকেই থাইল্যান্ডে ঘুরতে এসেছিলেন। মাসখানেক আগেই নেদারল্যান্ডস থেকে চিঠি লিখে তাঁদের খোঁজ জানতে চেয়েছিলেন এক ব্যক্তি।
চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন, এশিয়ায় ভ্রমণরত শ্যালিকা ও তাঁর প্রেমিক প্রতি সপ্তাহেই অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে নিজেদের পরিবারের কাছে অন্তত দুটি করে চিঠি লিখতেন। কিন্তু হঠাৎ তাঁরা দুজনই চিঠি লেখা বন্ধ করে দিয়েছেন। এমনকি ছয় সপ্তাহ কেটে গেলেও তাঁদের লেখা কোনো চিঠি পাওয়া যায়নি।
ব্যাংকক থেকে ৮০ কিলোমিটার উত্তরে আয়ুথায়ার কাছাকাছি একটি রাস্তায় ডাচ ব্যাকপেকার হেনরিকাস ও কর্নেলিয়ার পুড়ে যাওয়া লাশ দুটি পাওয়া গিয়েছিল। প্রথমে তাঁদের নিখোঁজ হয়ে থাকা এক অস্ট্রেলিয়ান দম্পতি ভেবেছিল সবাই। যদিও অস্ট্রেলিয়ান ওই দম্পতিকে পরে জীবিতই পাওয়া গিয়েছিল। এক দন্তচিকিৎসকের সহযোগিতায় দাঁতের চিহ্ন মিলিয়ে লাশ দুটি শেষ পর্যন্ত নিজ দেশের নিখোঁজ দুই ব্যাকপেকারের বলেই নিশ্চিত হয়েছিলেন ডাচ কূটনীতিক নিপেনবার্গ। দীর্ঘদিনের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় তিনি এটাও নিশ্চিত হয়েছিলেন, নৃশংস এই খুনের পেছনে যিনি ছিলেন তাঁর নাম চার্লস শোভরাজ!
কোনো স্মার্টফোন বা সোশ্যাল মিডিয়াও না থাকায় সেই সময়টিতে ভ্রমণকারীদের কেউ নিখোঁজ হয়ে গেলে তা অজানা থেকে যেত সপ্তাহের পর সপ্তাহ কিংবা মাস। এমন একটি শহরের কোলাহলপূর্ণ বাজার আর শান্ত মন্দিরগুলো লুকিয়ে রেখেছিল শোভরাজের মতো এক ধুরন্ধর শিকারিকেও। রঙিন চকমকে জীবনের খোলসে অনায়াসে তিনি মিশে গিয়েছিলেন শহরের প্রাণবন্ত আড্ডা, হাসি, তামাশায়। সুযোগ পেলেই ছোবল মারা ছিল তাঁর স্বভাব। সর্প স্বভাবের এই মানুষটিই পরবর্তীকালে হতে যাচ্ছিলেন বিংশ শতকের সবচেয়ে কুখ্যাত এবং অধরা সিরিয়াল কিলারদের একজন।
থাইল্যান্ডে শোভরাজ নিজেও ছিলেন বিদেশি। মায়ের দ্বিতীয় বিয়ের সূত্রে ফরাসি নাগরিক হলেও তাঁর বাবা ছিলেন ভারতীয়, আর মা ছিলেন ভিয়েতনামি। শোভরাজের জন্মও ভিয়েতনামে, ১৯৪৪ সালে। ভিয়েতনাম ও ভারতের সংমিশ্রণ তাঁর চেহারাকে একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য দিয়েছিল। এই বৈশিষ্ট্যই তাঁকে বিভিন্ন সংস্কৃতি এবং সমাজের মধ্য দিয়ে নির্বিঘ্নে চলাচলের সুযোগ করে দেয়। বিশেষ করে, নারীদের সঙ্গে ভাব জমাতে পটু ছিলেন তিনি।
শোভরাজের সবচেয়ে কুখ্যাত ছদ্মনামটি ছিল অ্যালাইন গোতিয়ার। এই নামের আড়ালেই তিনি তাঁর প্রেমিকা মেরি আন্দ্রে ল্যাক্লার্ক ওরফে মনিককে নিয়ে থাইল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশে একের পর এক অপারেশন চালাতেন। থাইল্যান্ডে থাকা অবস্থায় প্রায় সময়ই ব্যাংককের ভাড়া করা অ্যাপার্টমেন্টে তাঁরা শিকারকে প্রলুব্ধ করে নিয়ে যেতেন, কিংবা কোনো আড্ডায় আমন্ত্রণ জানাতেন। পরে শিকারের পানীয়তে মিশিয়ে দিতেন মাদকের ওভারডোজ। লুণ্ঠনের প্রমাণ মুছে দিতে শিকারকে প্রায়ই তাঁরা খুন করে গুম করে ফেলতেন। এই কাজে সহযোগিতার জন্য অজয় চৌধুরী নামে এক ভারতীয়কেও দলভুক্ত করেছিলেন শোভরাজ।
জীবনীকারদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭২ থেকে ১৯৭৬ সালের মধ্যে অন্তত ১২টি খুনের কথা শোভরাজ নিজের মুখেই স্বীকার করেছেন। তাঁর এ ধরনের হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছিলেন তেরেসা নোল্টন ও কনি জো ব্রোঞ্জিচ নামে দুই মার্কিন নারী ব্যাকপেকারও। বিকিনি পরা অবস্থায় তেরেসার মরদেহটি ভাসছিল থাইল্যান্ডের পাতায়া সমুদ্র উপকূলে। প্রথমে সবাই ভেবেছিল, হয়তো সাঁতার কাটতে গিয়েই প্রাণ হারিয়েছেন তেরেসা। কিন্তু তদন্তে বেরিয়ে আসে শোভরাজই তাঁকে নেশাগ্রস্ত করে পানিতে ডুবিয়ে মেরেছিলেন। আরেক আমেরিকান ব্যাকপেকার কনি জো ব্রোঞ্জিচের পুড়ে যাওয়া দেহাবশেষ আবিষ্কৃত হয়েছিল নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুর উপকণ্ঠে। এই দুটি ছাড়াও শারমাইন ক্যারো নামে আরও এক ফরাসি নারীর হত্যাকাণ্ড ‘বিকিনি কিলার’ হিসেবে পরিচিতি দেয় শোভরাজকে। তিনি শারামাইনের আগে তাঁর তুর্কি প্রেমিককেও খুন করেছিলেন। প্রেমিকের খোঁজে থাইল্যান্ডে এসে শারমাইন নিজেও শোভরাজের শিকারে পরিণত হন। তেরেসার মতো বিকিনি পরা অবস্থায় শারমাইনের লাশটিও সমুদ্রের পানিতে ভাসমান অবস্থায় পাওয়া যায়।
শুধু থাইল্যান্ড আর নেপাল নয়, ভারতেও দুই পর্যটককে খুনের দায়ে অভিযুক্ত ছিলেন শোভরাজ। তাঁর প্রতারণার জাল বিস্তৃত ছিল মালয়েশিয়া, তুরস্ক, গ্রিস ও আফগানিস্তানেও। তবে তাঁর অহংকার এবং কুখ্যাতির আকাঙ্ক্ষা শেষ পর্যন্ত তাঁকে পতনের দিকে টেনে নিয়ে যায়। ১৯৭৬ সালে শুরু করা ডাচ কূটনীতিক হারম্যান নিপেনবার্গের তদন্তই ঠান্ডা মাথার ওই খুনিকে শনাক্ত করে। তবে অকাট্য প্রমাণ হাতে আসার পরও কর্তৃপক্ষের চেয়ে এক ধাপ এগিয়ে ছিলেন শোভরাজ। থাইল্যান্ডে ধরা পড়ার আগেই প্রেমিকা মনিককে নিয়ে তিনি ভারতে পালিয়ে গিয়েছিলেন এবং যথারীতি সেখানেও নিজের কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছিলেন। ১৯৭৬ সালের জুলাইয়ে নয়াদিল্লিতে ফরাসি শিক্ষার্থীদের একটি দলকে মাদকে অচেতন করে সর্বস্ব লুট করতে চেয়েছিলেন তিনি। পরিকল্পনাটি শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হলে বিষপান ও ডাকাতির চেষ্টার অভিযোগে তাঁকে গ্রেপ্তার করে ভারতের পুলিশ। পরে তিহার জেলে তাঁর ১২ বছরের সাজা হয়।
গুপ্তের মতে, কারাগারে থাকা ধনী কয়েদিদের সঙ্গে সখ্য এবং আইনি পরামর্শ দিয়ে অনেক অর্থ হাতিয়ে নিতেন শোভরাজ। আর এসব অর্থ রক্ষীদের ঘুষ হিসেবে দিয়ে কারাগারকে নিজের বাড়িতে পরিণত করেছিলেন তিনি। সুনীল লিখেছেন সবাই তাঁকে ভয় পেত, সমীহ করত।
১৯৮৬ সালে একবার তিনি জেল থেকেও পালাতে সক্ষম হন। তবে তা কিছু সময়ের জন্য। নিজের ইচ্ছায়ই পরে আবার ধরা পড়েছিলেন। ধুরন্ধর শোভরাজ এভাবে মূলত নিজের সাজার মেয়াদ বাড়িয়ে নিতে চাইছিলেন। কারণ, ভারতের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে গেলে থাইল্যান্ডে প্রত্যর্পণ হওয়ার আশঙ্কা ছিল তাঁর। সেখানে তাঁর জন্য অপেক্ষা করছিল মৃত্যুদণ্ড। পরিকল্পনা শেষ পর্যন্ত সফলও হয়। জেল পালানোর অপরাধে ভারতে তাঁর সাজার মেয়াদ আরও ১০ বছর বেড়ে যায়। ১৯৯৭ সালে মুক্তি পাওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি ভারতের জেলেই ছিলেন। তত দিনে সংবিধান অনুযায়ী থাইল্যান্ডে তাঁর মৃত্যুদণ্ড তামাদি হয়ে গিয়েছিল।
ভারতে মুক্তির পর তাই নিজের দেশ ফ্রান্সে ফিরে যান শোভরাজ। অবাক করা বিষয় হলো, ফ্রান্সে তিনি খোলাখুলিভাবেই থাকতেন এবং অর্থের বিনিময়ে নিজের অপরাধের বর্ণনা দিয়ে নিয়মিত সাক্ষাৎকার দিয়ে বেড়াতেন। তবে তাঁর সেই স্বাধীনতা খুব বেশি দিন টেকেনি। কারণ, ২০০৩ সালে তিনি ভুল করে আবারও নেপালে পা রেখেছিলেন, যেখানে তিনি অন্তত দুজন পর্যটককে খুনের দায়ে ওয়ান্টেড ছিলেন। তাঁর উপস্থিতি নজর এড়ায়নি নেপাল কর্তৃপক্ষের। ফলে তাঁকে গ্রেপ্তার করে দেশটির পুলিশ এবং বিচারে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
ইতিহাসের কুখ্যাত এই খুনি এখনো ফ্রান্সের মুক্ত বাতাসে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। অর্থের বিনিময়ে সাক্ষাৎকার দিচ্ছেন। এমনকি তাঁর জীবনী লিখতে চাওয়া এক লেখককে অনুমতি দিতে সম্প্রতি দেড় মিলিয়ন ডলারও দাবি করেছেন।