ভারতের উত্তর প্রদেশ রাজ্যের শহর প্রয়াগরাজে (সাবেক এলাহাবাদ) শুরু হয়েছে পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে বড় জনসমাগম মহাকুম্ভ মেলা। আজ সোমবার শুরু হওয়া এই মেলায় যোগ দিতে এরই মধ্যে শহরটিতে হাজির হয়েছেন লাখ লাখ মানুষ। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা গেছে।
প্রতি এক যুগ, অর্থাৎ ১২ বছর পরপর এই মেলাটি অনুষ্ঠিত হয়। আজ সোমবার থেকে শুরু হয়ে এই মেলা চলবে পরবর্তী ছয় সপ্তাহ। ভারতের সবচেয়ে পবিত্র নদী গঙ্গার সঙ্গে যমুনা এবং পৌরাণিক সরস্বতী নদীর সংযোগস্থলে—যা সঙ্গম নামে পরিচিত—গোসল করার এই উৎস বহু আগে থেকেই প্রচলিত।
হিন্দুরা বিশ্বাস করেন, পবিত্র নদীতে স্নান বা গোসল করলে পাপ মোচন হয়, আত্মা বিশুদ্ধ হয় এবং জন্ম-মৃত্যুর চক্র থেকে মুক্তি লাভ করা যায়। কারণ, হিন্দুধর্মের চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো মোক্ষ লাভ। প্রায় ৪০ কোটি তীর্থযাত্রী এই ৪৫ দিনের মহাসমাবেশে অংশগ্রহণ করার জন্য আসবেন। এই মেলার আকার এতই বিশাল যে এটি মহাকাশ থেকেও দেখা যায়।
এই উৎসবটি আগামী ২৬ ফেব্রুয়ারি শেষ হবে এবং এটি জাতিসংঘের সংস্থা ইউনেসকোর পক্ষ থেকে ইনট্যানজিবল হেরিটেজ অব হিউম্যানিটি বা মানবতার অমূর্ত ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃত। এই মহাকুম্ভ মেলার সূত্রপাত মূলত একটি পৌরাণিক কাহিনির মাধ্যমে। কাহিনি অনুসারে, সমুদ্র মন্থনের ফলে সৃষ্ট এক কুম্ভ বা পেয়ালা অমৃতের জন্য দেবতা ও অসুরেরা লড়াই করেছিলেন এখানে। যুদ্ধের সময় কুম্ভ থেকে অমৃতের কিছু ফোঁটা পড়ে প্রয়াগরাজ, হারিদ্বার, উজ্জয়িন ও নাসিক শহরে।
পুরাণ অনুসারে, এই দেবতা ও অসুরদের মাঝে এই যুদ্ধটি চলেছিল ১২ স্বর্গীয় বছর ধরে। এই ১২ বছরকে পৃথিবীর ১২ বছরের সমান হিসেবে ধরে প্রতি এক যুগ পরপরও এই চার শহরে কুম্ভ মেলা অনুষ্ঠিত হয়। দুই উৎসবের মধ্যে আধ কুম্ভ বা অর্ধকুম্ভ মেলাও অনুষ্ঠিত হয়।
মেলা চারটি শহরে অনুষ্ঠিত হলেও সবচেয়ে বেশি মানুষের সমাগম হয় প্রয়াগরাজে। হিন্দু সাধু মহন্ত রবীন্দ্র পুরী বলেন, এবারের উৎসবটি বিশেষভাবে বিশেষ এবং তিনি এটিকে ‘মহাকুম্ভ’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। কারণ, বর্তমান মেলার সময় গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থান সেই অবস্থানের সঙ্গে একেবারে মিলে গেছে যা অমৃতের ফোঁটা পড়ার সময় ছিল। তিনি আরও বলেন, ‘এমন পূর্ণতা ১২টি কুম্ভ উৎসব বা ১৪৪ বছর পর দেখা যায়।’
জ্যোতিষীরা এবারের মেলায় পুণ্যার্থীদের স্নানের জন্য বেশ কয়েকটি শুভদিন নির্ধারণ করেছেন। এবারের জন্য ছয়টি বিশেষ শুভ দিন রয়েছে স্নানের জন্য। সেগুলো হলো—১৩ জানুয়ারির পৌষ পূর্ণিমা, ১৪ জানুয়ারির মকর সংক্রান্তি, ২৯ জানুয়ারির মৌনী অমাবস্যা, ৩ ফেব্রুয়ারির বসন্ত পঞ্চমী, ১২ ফেব্রুয়ারির মাঘী পূর্ণিমা এবং ২৬ ফেব্রুয়ারির মহা শিবরাত্রি।
এদিনগুলোর মধ্যে ১৪ ও ২৯ জানুয়ারি এবং ৩ ফেব্রুয়ারি শাহি স্নানের (অথবা রাজস্নান) দিন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এদিনগুলোতে নাগা সন্ন্যাসীরা স্নান করবেন। সবচেয়ে বড় সমাবেশটি হতে পারে ২৯ জানুয়ারি প্রত্যাশিত। এদিন, ৫ থেকে ৬ কোটি স্নান করবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।
নদীতীরে অবস্থিত প্রয়াগরাজ শহরটিকে উৎসবের জন্য সাজানো হয়েছে। কর্মকর্তারা বলেছেন, প্রায় ২০০ রাস্তা চওড়া করা হয়েছে এবং স্নানের মূল স্থান সঙ্গমের দিকে যাওয়া সড়কের দুই পাশের দেয়ালে নতুন রঙের প্রলেপ দেওয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে দেয়ালগুলোতে হিন্দু পৌরাণিক কাহিনির গল্প তুলে ধরে রঙিন চিত্রকলা এবং ম্যুরাল তৈরি করা হয়েছে।
বিপুলসংখ্যক বিদেশিসহ তিন লাখেরও বেশি তীর্থযাত্রী এরই মধ্যে প্রয়াগরাজে পৌঁছেছেন। আর্জেন্টিনার ৯০ সদস্যবিশিষ্ট একটি দলের সদস্য সেবাস্তিয়ান দিয়েগো বলেন, তিনি এক মৌলিক অনুভূতি অর্জনে প্রয়াগরাজে এসেছেন। তিনি বলেন, ‘আমি গঙ্গার প্রতি তীব্র আকর্ষণ অনুভব করি, তাই এসেছি। আমি নদীতে স্নান করব। কারণ, আমি গঙ্গার সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করার প্রয়োজন অনুভব করছি।’
এদিকে, ভক্তদের আশ্রয় দিতে ৪ হাজার হেক্টর এলাকাজুড়ে ১ লাখ ৬০ হাজার তাঁবু খাটানো হয়েছে। পুরো মেলার কার্যক্রম তদারক করতে ৪০ হাজার পুলিশ ও নিরাপত্তাকর্মী, ১৫ হাজার পরিচ্ছন্নতাকর্মী মোতায়েন করা হয়েছে। ৯৯টি পার্কিং লট তৈরি করা হয়েছে, যেখানে ৫ লাখ গাড়ি রাখা যাবে। এ ছাড়া, ৩০টি ভাসমান সেতু তৈরি করা হয়েছে যাতায়াতের সুবিধার জন্য।
এ ছাড়া, ৬৭ হাজার ল্যাম্পপোস্ট, দেড় লাখ টয়লেট, ২৫ হাজার ডাস্টবিন, ২০০টি ভাসমান পানির বুথ এবং ৮৫টি নলকূপ স্থাপন করা হয়েছে। ভারত সরকার জানিয়েছে, তারা উৎসবটি আয়োজনের জন্য ৭ হাজার কোটি রুপি ব্যয় করছে। স্থানীয় গণমাধ্যমের খবর অনুসারে, এই মেলা থেকে রাজ্য সরকার ২৫ হাজার কোটি রুপি রাজস্ব উপার্জন করবে।