সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ে গত বুধবার ১৩তম বারের মতো আয়োজিত হয়েছে বার্ষিক আন্তধর্মীয় ইফতার। বিশ্বের ৩০টির বেশি জাতীয়তার প্রায় ২৭৫ জন মানুষ এতে অংশ নেন। বহু পুরোনো ঐতিহ্য এই ইফতার আয়োজন। যেখানে শুধু নিরামিষ খাবার পরিবেশন করা হয়।
গালফ নিউজের একটি প্রতিবেদনে এই ঐতিহ্যবাহী আয়োজনের কথা উঠে এসেছে।
এই আয়োজন হয়েছিল দুবাইয়ের জেবেল আলি এলাকায় ওয়ারশিপ ভিলেজের গুরুদুয়ারায়। গুরু নানকের দরবার শরিফ গুরুদুয়ারা। শিখধর্মাবলম্বীদের একটি উপাসনালয়। বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন জায়গায় শিখদের এই সমাবেশস্থল রয়েছে। দুবাইয়ের গুরুদুয়ারার এই ব্যতিক্রমী আয়োজন ঐক্য, শান্তি ও সহনশীলতার বাহক হিসেবে বিশ্বের সামনে উঠে এসেছে।
গুরুদুয়ারার চেয়ারম্যান সুরেন্দর সিং কন্ধারি বলেন, সংযুক্ত আরব আমিরাতে মানুষের পরস্পরের ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্প্রীতি এই আয়োজনের মাধ্যমে প্রমাণিত হয়। তিনি আরও বলেন, ‘ইফতার আয়োজনের মাধ্যমে, আমরা শান্তি, ভালোবাসা ও মানবতার বার্তা ছড়িয়ে দিচ্ছি। সংযুক্ত আরব আমিরাতের শাসকদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি, যাঁরা আমাদের দেশে সম্প্রীতি বজায় রাখার সুযোগ দিয়েছেন। আমরা আমাদের মুসলিম ভাই-বোনদের জন্য একটি বরকতময় মাস কামনা করছি এবং তাঁদের সমৃদ্ধির জন্য প্রার্থনা করছি।’
কন্ধারি আরও বলেন, এ বছরের বহুধর্মীয় ইফতার বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। কারণ, প্রেসিডেন্ট শেখ মোহাম্মদ বিন জায়েদ আল নাহিয়ান ‘ইয়ার অব কমিউনিটি’ ঘোষণা করেছেন। এর মূল প্রতিপাদ্য হলো ‘হাত ধরে এগিয়ে চলা’, যার অর্থ হলো—আমরা একে অপরের হাত ধরছি, একে অপরকে সাহায্য ও সমর্থন করছি। গুরুদুয়ারার স্বেচ্ছাসেবী কার্যক্রমের মাধ্যমে একই বার্তা পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করা হয় বলে জানান কন্ধারি।
দুবাইয়ের বিশিষ্ট নাগরিক এবং সাবেক আমিরাতি কূটনীতিক মির্জা আল সায়েঘ গুরুদুয়ারার ইফতারের নিয়মিত অংশগ্রহণকারী। তিনি বলেন, ‘প্রতিবছর গুরুদুয়ারার ইফতারে এলে আমি উপলব্ধি করি, সব ধর্মই শান্তি ও সম্প্রীতির কথা বলে। এখানে ইফতারের আয়োজন বিভিন্ন পটভূমির মানুষের গভীর সংহতির প্রতিফলন ঘটায়। এটি এমন একটি অনুষ্ঠান, যা সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ভারতকে একত্র করে।’
দুবাইয়ে ভারতীয় কনসাল জেনারেল সতীশ কুমার শিবন গুরুদুয়ারার উদ্যোগের প্রশংসা করে বলেন, ‘আমি গুরুদুয়ারার ইফতারে উপস্থিত হতে পেরে আনন্দিত। এত বছর ধরে এই আয়োজনের মাধ্যমে তাঁরা সহনশীলতা, অন্তর্ভুক্তিমূলক দৃষ্টিভঙ্গি ও মানবতার উদাহরণ তুলে ধরেছেন, যা সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে এগিয়ে চলেছে। এটি আমাদের জন্য একটি সুযোগ, ভারতও সংযুক্ত আরব আমিরাতের সঙ্গে সহনশীলতার এই চেতনাকে সমর্থন করে।’
এদিকে দুবাই কোয়ালিটি গ্রুপের ম্যানেজিং ডিরেক্টর এবং এমিরাতি নাগরিক সামিরা মোহাম্মদ বলেন, ‘গুরুদুয়ারার ইফতার অনুষ্ঠান সংযুক্ত আরব আমিরাতের সহনশীলতা প্রচারের কৌশল এবং ‘কমিউনিটির বছর’-এর লক্ষ্যকে বাস্তবায়নের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এখানে আসতে পেরে আমি অত্যন্ত আনন্দিত। এখানে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ ও ভিআইপিরা উপস্থিত রয়েছেন। এই বিশেষ ইফতার অনুষ্ঠানে অংশ নিতে পেরে সত্যিই সম্মানিত বোধ করছি।’
আমেরিকান নাগরিক স্টিভেন এরিকসেন ইফতারে যোগ দিতে আবুধাবি থেকে বিশেষভাবে এসেছেন। আবুধাবিতে অবস্থিত ‘দ্য চার্চ অব জিসাস ক্রাইস্ট অব ল্যাটার-ডে সেইন্টস’-এর একজন স্বেচ্ছাসেবক। তিনি বলেন, ‘আমি ও আমার স্ত্রী প্রায় দেড় বছর আগে যুক্তরাষ্ট্র থেকে এখানে এসেছি। এখানে আসার পর আমাদের প্রথম কার্যক্রমগুলোর মধ্যে একটি ছিল গুরুদুয়ারা পরিদর্শন করা। কারণ, আমাদের চার্চ শিখ মন্দিরের সঙ্গে পারস্পরিক অংশীদারিতে বিভিন্ন সামাজিক সেবামূলক কাজ পরিচালনা করে। গত বছর থেকে আমরা আন্তধর্মীয় ইফতারে অংশ নিতে শুরু করেছি এবং এটি আমাদের জন্য অত্যন্ত আনন্দের। মাথায় পাগড়ি পরা বা জুতা খোলা কোনো অসুবিধা নয়; বরং এটি আমাদের জন্য সম্মানের বিষয়, আমরা এখানে এসে তাদের সংস্কৃতির অংশ হতে পারছি।’
সাধারণত যাঁরা মাথা ঢেকে রাখেন না, তাঁদেরও এই আয়োজনে ‘হেড কভার’ পরা বাধ্যতামূলক ছিল। এ ছাড়া স্থানটিতে প্রবেশের আগে সবাইকে তাঁদের জুতাগুলো খুলে রাখতে হয়েছিল। কন্ধারি বলেন, ‘গুরুদুয়ারার ঐতিহ্য অনুযায়ী, সরকারি কর্মকর্তা, আরব আমিরাতের বিশিষ্ট নাগরিক, ধর্মীয় নেতা, বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকসহ সবাই জুতা খুলে প্রবেশ করেন এবং যাঁরা কন্দুরা বা পাগড়ি পরেননি, তাঁরা হেড কভার ব্যবহার করেন।’
গুরুদুয়ারাটি বিভিন্ন সামাজিক সেবামূলক কাজের সঙ্গে যুক্ত; বিশেষ করে তারা ‘লঙ্গর’ নামে পরিচিত কমিউনিটি রান্নাঘরের জন্য জনপ্রিয়, যেখানে ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে সব দর্শনার্থীর জন্য প্রতিদিন তিন বেলা বিনা মূল্যে খাবার পরিবেশন করা হয়।