হামাসের সঙ্গে ইসরায়েলের চলমান সংঘাতের তৃতীয় দিন গাজায় নিজ বাড়ির ড্রয়িংরুমে স্বামী খালেদের ঠিক উল্টো পাশেই বসেছিলেন সিহাম নাজি। এ সময়ই তাঁর মনে পড়ল ওষুধ খাওয়ার কথা।
সিহাম ড্রয়িংরুম থেকে রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে গেলেন এবং ওষুধ খেতে পানির জন্য ফ্রিজের দরজাটি খুললেন। ঠিক এ মুহূর্তেই নিজেকে নরকের মধ্যে আবিষ্কার করলেন তিনি।
সিহাম বলেন, ‘আমি মেঝের মধ্যে ছিটকে পড়লাম এবং গরম কিছু অনুভব করলাম।’ তাঁর চারপাশ অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে গেছে ততক্ষণে, বাতাসে শুধু ধুলা আর ধুঁয়া উড়ছিল। ধ্বংসযজ্ঞের শব্দ তখনো কানে বাজছিল তাঁর।
একটি ইসরায়েলি মিসাইলের আঘাতে পাশের বাড়িটি পুরোপুরিভাবে মাটিতে মিশে গিয়েছিল এবং সিহামের বাড়িটিও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। মেঝেতে শুয়ে থেকেই তিনি কয়েকবার স্বামীকে ডাকেন। পরে ড্রয়িংরুম থেকে তিনি গোঙানির আওয়াজ শুনতে পান।
একপর্যায়ে হামাগুড়ি দিয়ে ড্রয়িংরুমে পৌঁছে সিহাম দেখতে পান, স্বামী খালেদের শরীরের নিচের অংশ ইট-কংক্রিটের ধ্বংসাবশেষের নিচে পড়ে আছে। আর তাঁর মুখ দিয়ে ছিটকে রক্ত বেরোচ্ছে।
পরে অবশ্য ছেলেকে সঙ্গে নিয়েই স্বামী খালেদকে ধ্বংসাবশেষের নিচ থেকে টেনে বের করেন সিহাম। তিনজনই বিধ্বস্ত বাড়ি থেকে রক্তাক্ত ও আহত অবস্থায় বেরিয়ে আসেন।
গত কয়েক বছর টানা পরিশ্রম করে বাড়িটি তিলে তিলে গড়ে তুলেছিলেন খালেদ। দুটি লিভিং রুম ছাড়াও এই বাড়িতে ছিল ৩টি শয়নকক্ষ, একটি রান্নাঘর একটি বড় বাথরুম। আর বাড়িটির দ্বিতীয় তলায় আংশিক কাজ শেষ হওয়া একটি ফ্ল্যাটও ছিল। মূলত সিহাম ও খালেদের বিবাহিত পুত্রের জন্যই নতুন ফ্ল্যাটটি নির্মাণ করা হয়েছিল।
৫১ বছর বয়সী খালেদ বলেন, ‘মনে হতো আমি আমার নিজের প্রাসাদে আছি। আমার সব জীবন এবং স্বপ্ন এই বাড়ির ভেতরেই ছিল।’
তিনি আরও বলেন, ‘বাগানের দিকটাতে একটা ব্যালকনি নির্মাণের প্রক্রিয়া চলছিল। বাড়ির আঙিনায় শিশুদের জন্য একটি সুইমিংপুল বানানোরও পরিকল্পনা ছিল, যাতে তারা গ্রীষ্মকালে সেখানে সাঁতার কাটতে পারে।’
হামলার এক দিন পর খালেদ তাঁর বিধ্বস্ত বাড়িটি পর্যবেক্ষণ করতে গিয়েছিলেন। তিনি বলেন, ‘বছরের পর বছর ধরে আমি আমার স্ত্রীর সহযোগিতা নিয়ে নিজ হাতে তিলে তিলে বাড়িটি গড়েছি। আমি নিজেই কংক্রিটের মিশ্রণ তৈরি করেছি, বাড়ির নকশা করেছি এবং ভালো আসবাব নিয়ে এসেছি।’
এই পরিস্থিতিতে পরিবারটি আবারও ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া নিজেদের বাড়িতে ফিরে আসারই সিদ্ধান্ত নেয়। অন্তত উদ্বাস্তু জীবনের চেয়ে নিজেদের ভাঙা বাড়িটিকেই ভালো মনে হয়েছে তাঁদের কাছে। একটি কক্ষ থেকে ইট-কংক্রিট সরিয়ে যতটুকু সম্ভব পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে একটি ম্যাট্রেসের ওপর পরিবারের সবাই এখন ঘুমায়। এই কক্ষের কোনো দরজা নেই, উড়ে গেছে জানালাগুলোও।
খালেদ বলেন, ‘কোথায় আর যাব। আমার সন্তানেরা যদি ইসরায়েলি ট্যাংকের আঘাতে না মরে, তবে তারা ঠান্ডায় জমে কিংবা রোগে আক্রান্ত হয়ে মরবে। কোনো তাঁবুর ভেতরে না মরে আমি বরং আমার বাড়িতেই মারা যাব।’