১৭৯৮ সালে নেপোলিয়নের মিসর আক্রমণের পর কায়রো, দামেস্ক ও ইস্তাম্বুলের মতো বিখ্যাত মুসলিম শহরগুলোতে ইউরোপীয়রা অবাধে আসতে শুরু করে। এ সময় পশ্চিমা শিল্পীরা প্রাচ্যকে কাল্পনিকতা মিশিয়ে আপত্তিকর উপাদানে চিত্রিত করেন। মুসলিম বিশ্বের পশ্চিমঘেঁষা শিল্পীরাও এসব প্রাচ্যবাদী শিল্পীর পদাঙ্ক অনুসরণ করে চলেছেন তখন।
এমন সময়ে ১৮৪২ সালে অটোমান সাম্রাজ্যের এক বড় সরকারি কর্মকর্তার ঘরে জন্ম নেন ওসমান হামদি বে। ইস্তাম্বুলে আইন নিয়ে পড়াশোনা শেষ করার পর প্যারিসে যান। চিত্রকলার প্রতি তুমুল আগ্রহের কারণে প্যারিসের বিখ্যাত আর্ট স্কুল ‘ইকোলে ডেস বেউক্স আর্ট’-এ ভর্তি হন। সেখানে প্রভাবশালী প্রাচ্যবাদী শিল্পী জিন-লিওন জেরোম ও গুসতাভ বোলাঁজারের সান্নিধ্যে পশ্চিমা চিত্রশিল্প ভালোই আত্মস্থ করেন।
প্যারিস থেকে ফিরে ওসমান পশ্চিমা শিল্পীদের নির্দেশিত পথে হাঁটেননি। খুব কাছ থেকে দেখা নিজের সমাজ-সংস্কৃতিকে নিজের মতো করে মর্যাদাপূর্ণ উপাদানে তুলে ধরার অভিযাত্রায় নামেন তিনি। ইউরোপীয় শিল্পীরা সাধারণত প্রাচ্যের অবমাননাকর চিত্রই আঁকতেন। নারীদের হেরেম, যৌনতা ও পুরুষদের পানশালার আড্ডাতেই সীমাবদ্ধ ছিল তাঁদের থিমগুলো।
ওসমান হামদি বে তাঁর শিল্পকর্মে সচেতনভাবেই নগ্নতা এড়িয়ে যান। তিনি তুলে ধরেন—একজন মুসলিম পণ্ডিত জ্ঞানচর্চায় কীভাবে সময় পার করছেন, কীভাবে একজন মুসলিম নারী কোরআন তিলাওয়াত করছেন, একজন মুসলিম বুদ্ধিজীবী কীভাবে আলাপ করছেন, মসজিদের সামনে দাঁড়িয়ে একজন মুসল্লি কীভাবে সময় কাটাচ্ছেন ইত্যাদি। এসব শিল্পকর্ম ইউরোপীয়দের কাছে প্রাচ্যকে ভিন্নভাবে উপস্থাপন করেছে।
হামদি বে’র শিল্পকর্মে ঐতিহ্য ও বিদ্রোহ বেশ আকর্ষণীয় রূপে ফুটে উঠেছে। পশ্চিমা মোটিফগুলোর অন্ধ অনুকরণের বদলে তিনি সেগুলোর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। মুসলিম বিশ্বে ইউরোপীয় আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করে প্রাচ্যকে ফের নতুনভাবে শ্রেষ্ঠত্ব দিতে চেয়েছেন। তাঁর সব শিল্পকর্মেই প্রতিরোধের ডাক লুকিয়ে আছে। রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আধিপত্যের বিরুদ্ধে যা যুগপৎ ভূমিকা রাখে।
প্রাচ্যবাদী উপাদান গ্রহণ করে তাদেরই নির্দেশিত লেন্স ভেঙে অটোমান ঐতিহ্যের প্রলেপে তিনি ছবি এঁকেছেন। তাই তো সাম্প্রতিক সময়ে ওসমান হামদি বে’র চিত্রকর্মগুলো ইউরোপের বিভিন্ন দেশে মিলিয়ন-মিলিয়ন ডলারে বিক্রি হচ্ছে। এখন পর্যন্ত তিনিই তুরস্কের ইতিহাসে সবচেয়ে দামি চিত্রকর্মের স্রষ্টা।
ইস্তাম্বুল প্রত্নতত্ত্ব জাদুঘরেও ওসমান হামদির বেশ কিছু বিখ্যাত চিত্রকর্ম রয়েছে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে মুসলমানদের ইতিহাস-ঐতিহ্য তুলে ধরতে তা দারুণ ভূমিকা রাখছে।
সূত্র: টিআরটি ওয়ার্ল্ড