পিতামাতার মর্যাদা আল্লাহ তাআলার কাছে অত্যন্ত মহান। তাই তিনি তাঁদের প্রতি সদাচরণের নির্দেশ দিয়েছেন এবং বিশেষভাবে মায়ের অধিকারের প্রতি গুরুত্বারোপ করেছেন। পিতামাতার প্রতি সদাচরণ হলো—তাঁদের প্রতি সদয় হওয়া, সহানুভূতি প্রদর্শন করা, নরম ব্যবহার করা, তাঁদের অবস্থা লক্ষ্য রাখা, কখনোই তাঁদের প্রতি অসদাচরণ না করা এবং এমনকি তাঁদের বন্ধুদের প্রতিও সম্মান প্রদর্শন করা।
এ কারণেই আল্লাহ তাআলা পিতামাতার প্রতি সদাচরণকে তাঁর ইবাদত ও তাওহিদের সঙ্গে সংযুক্ত করেছেন এবং তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতাকে তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতার সঙ্গে একত্রে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন—‘আমার প্রতি কৃতজ্ঞ হও এবং তোমার পিতামাতার প্রতিও কৃতজ্ঞ হও। আমারই কাছে (তোমাদের) প্রত্যাবর্তন হবে।’ (সুরা লুকমান, আয়াত: ১৪-১৫)
পবিত্র কোরআনে আরও ইরশাদ হচ্ছে, ‘তোমার প্রতিপালক আদেশ দিয়েছেন যে, তিনি ছাড়া অন্য কারও ইবাদত না করতে এবং পিতামাতার প্রতি সদাচরণ করতে।’ (সুরা বনি ইসরাইল, আয়াত: ২৩)
পক্ষান্তরে পিতামাতার প্রতি অসদাচরণ করা, কষ্ট দেওয়া বা তাঁদের কথা অমান্য করা, আর তাঁরা যদি এতে কষ্ট পেয়ে বদদোয়া বা অভিশাপ দেন, তাহলে তা আল্লাহ তাআলা কবুল করে নেন।
হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তিন প্রকারের দোয়া অবশ্যই মঞ্জুর করা হয়, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। নির্যাতিত ব্যক্তির দোয়া, মুসাফিরের দোয়া এবং সন্তানের প্রতি বাবা-মার বদদোয়া।’ (তিরমিজি, হাদিস: ১৯০৫)
এমনই এক মায়ের বদদোয়ার ঘটনা সহিহ হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, যাঁর দোয়া আল্লাহ তাআলা কবুল করেছেন। নিচে ওই ঘটনা তুলে ধরা হলো—
হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন, নবী (সা.) বলেন, তিনজন শিশু ছাড়া আর কেউ দোলনায় থেকে কথা বলেনি। প্রথমজন ইসা (আ.)। দ্বিতীয়জন (এক শিশু, যার কথা এসেছে) বনি ইসরাইলের ‘জুরাইজ’ নামের এক ব্যক্তির ঘটনায়। একদা ইবাদতে রত থাকা অবস্থায় জুরাইজের মা এসে তাঁকে ডাকলেন। তিনি ভাবলেন, আমি কি তাঁর ডাকে সাড়া দেব, না নামাজ আদায় করতে থাকব। তাঁর মা বললেন, ‘হে আল্লাহ, ব্যাভিচারিণীর মুখ না দেখা পর্যন্ত তুমি তাকে মৃত্যু দিও না।’ জুরাইজ তাঁর ইবাদতখানায় থাকতেন। একবার তাঁর কাছে এক নারী এসে তাঁর সঙ্গে (মনোবাসনা পূরণের) কথা বললেন। কিন্তু জুরাইজ তা অস্বীকার করলেন। এরপর নারীটি একজন রাখালের কাছে গেলেন এবং তাঁকে দিয়ে মনোবাসনা পূর্ণ করলেন। পরে তিনি এক পুত্র সন্তান প্রসব করলেন। তাঁকে জিজ্ঞেস করা হলো, ‘এটি কার বাচ্চা?’ ওই নারী বললেন, ‘জুরাইজের।’ লোকজন তাঁর কাছে এলো এবং তাঁর ইবাদতখানা ভেঙে দিল। আর তাঁকে নিচে নামিয়ে এনে গালিগালাজ করল। তখন জুরাইজ অজু সেরে ইবাদত করলেন। এরপর নবজাত শিশুটির কাছে এসে তাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘হে শিশু, তোমার পিতা কে?’ সে জবাব দিল, ‘অমুক রাখাল।’ তারা বলল, ‘আমরা আপনার ইবাদতখানাটি সোনা দিয়ে তৈরি করে দিচ্ছি।’ জুরাইজ বললেন, ‘না। তবে মাটি দিয়ে।’ (বুখারি, হাদিস: ৩৪৩৬; মুসলিম, হাদিস: ২৫৫০)
এ এক দুর্লভ দৃষ্টান্ত। মায়ের অভিশাপের শক্তি যেমন অপ্রতিরোধ্য, তেমনি আল্লাহর প্রতি গভীর আনুগত্য সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করতেও সক্ষম।
গল্প থেকে শিক্ষা
পিতামাতার অবাধ্যতা ও তাঁদের প্রতি সদাচরণ না করা এবং তাঁদের আদেশ অমান্য করা মানুষের জীবনে নানা বিপর্যয়ের কারণ হতে পারে। যেমনটি ঘটেছিল এই নেককার ও পরহেজগার (জুরাইজ) ব্যক্তির ক্ষেত্রে, যিনি তাঁর মায়ের প্রতি কর্তব্য পালনে অবহেলা করেছিলেন।
আল্লাহ তাআলা তাঁর নেক বান্দাদের সততা ও তাকওয়ার প্রতিদান দেন। যেমন তিনি জুরাইজ নামক ওই নেককার ব্যক্তিকে মিথ্যা অপবাদের হাত থেকে রক্ষা করেছিলেন এবং তাঁর নির্দোষ হওয়ার বিষয়টি একটি শিশুর মুখ থেকে প্রমাণ করেছিলেন।
আল্লাহ তাআলার অসীম ক্ষমতার মধ্যে রয়েছে এমন ব্যক্তিদের কথা বলিয়ে দেওয়া, যাদের কথা বলার সাধ্য নেই। যেমন, তিনি জুরাইজকে নির্দোষ প্রমাণের জন্য এক নবজাতক শিশুকে কথা বলিয়েছিলেন।
যদি কেউ নফল নামাজ আদায়রত থাকে এবং তার পিতামাতা কোনো ন্যায়সঙ্গত প্রয়োজনে ডাক দেয়, তবে তাকে নামাজ ছেড়ে তাঁদের ডাকে সাড়া দেওয়া উচিত। কেননা, হাদিস থেকে বোঝা যায়, জুরাইজ তাঁর মায়ের আহ্বানে সাড়া না দিয়ে ভুল করেছিলেন এবং এ কারণে আল্লাহর নিকট তিনি অপরাধী সাব্যস্ত হন।
যদি কোনো বান্দা ধৈর্য ও তাকওয়ার সঙ্গে পরীক্ষা-নিরীক্ষার সম্মুখীন হয়, তবে পরিণামে তার অবস্থার উন্নতি হয়। যেমন, জুরাইজের সম্মান ও মর্যাদা তাঁর বিপদের পর আরও বৃদ্ধি পেয়েছিল—মানুষের দৃষ্টিতে এবং সর্বোপরি আল্লাহর নিকটও।
কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে প্রমাণ ও সুনিশ্চিত সাক্ষ্য ছাড়া তা বিশ্বাস করা উচিত নয়। জুরাইজের কওম তাঁর অপরাধ যাচাই না করেই তাঁর ওপর চড়াও হয়েছিল, তাঁকে গালি দিয়েছিল, এমনকি আঘাতও করেছিল। অথচ, তাঁদের উচিত ছিল সঠিক তদন্ত করা, সত্য-মিথ্যা যাচাই করা এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা।