লাইলাতুল কদর বা কদরের রাত আমাদের কাছে শবে কদর নামেই বেশি পরিচিত। কোরআনের ভাষ্যমতে, এটি হাজার মাসের চেয়ে শ্রেষ্ঠ রাত। মহিমান্বিত ও বরকতময় এ রাতকে আল্লাহ তাআলা রহস্যে মুড়িয়ে রেখেছেন। শবে মিরাজ ও শবে বরাতের দিন-তারিখ নির্ধারিত হলেও শবে কদরের সুনির্দিষ্ট কোনো দিন-তারিখ নেই। হাদিসের ভাষ্য থেকে বোঝা যায়, রমজানের, বিশেষত শেষ দশকের যেকোনো রাতই শবে কদর হতে পারে। তাই এ পবিত্র রাতের সন্ধানের চেষ্টা করা আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের বৈশিষ্ট্য।
শবে কদরের বৈশিষ্ট্য
শবে কদর বছরের শ্রেষ্ঠ রাত। শুধু তা-ই নয়, পবিত্র কোরআনে একে হাজার মাসের চেয়ে শ্রেষ্ঠ আখ্যা দেওয়া হয়েছে। কারণ, আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের বাণী ও মানবতার মুক্তির সংবিধান পবিত্র কোরআন এ রাতেই নাজিল হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আমি একে নাজিল করেছি এক বরকতময় রাতে, নিশ্চয়ই আমি সতর্ককারী। এ রাতে প্রতিটি প্রজ্ঞাপূর্ণ বিষয় স্থিরীকৃত হয়।’ (সুরা: দুখান: ৩-৪) আরও নির্দিষ্ট করে শবে কদরের নামোল্লেখ করে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আমি একে নাজিল করেছি শবে কদরে।’ (সুরা কদর: ১)
তাফসিরগ্রন্থগুলো থেকে জানা যায়, পবিত্র কোরআন শবে কদরে নাজিল করা হয়েছে—এর অর্থ হলো, লাওহে মাহফুজ থেকে সমগ্র কোরআন দুনিয়ার আকাশে এ রাতেই নাজিল করা হয়েছে। এরপর রাসুল (সা.)-এর নবুয়তি জীবনের ২৩ বছরে অল্প অল্প করে তা নাজিল করা হয়েছে।
এ রাতকে মোবারক বলার কারণ হলো, এ রাতে আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে অসংখ্য কল্যাণ ও বরকত নাজিল হয়। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘এ রাতে ফেরেশতাগণ ও জিবরাইল (আ.) প্রতিটি কাজে তাদের প্রতিপালকের অনুমতিক্রমে অবতীর্ণ হয়। এ রাত (আদ্যোপান্ত) শান্তি ফজর হওয়া পর্যন্ত।’ (সুরা কদর)
শবে কদর কোন রাতে?
শবে কদরের দিন-তারিখ সুনির্দিষ্ট না হলেও মহানবী (সা.)-এর একাধিক হাদিস থেকে বোঝা যায়, রমজানের শেষ দশকেই শবে কদর হওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। যেমন এক হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আমি কদরের রাতের সন্ধানে প্রথম ১০ দিন ইতিকাফ করলাম। এরপর ইতিকাফ করলাম মধ্যবর্তী ১০ দিন। এরপর ওহির মাধ্যমে আমাকে জানানো হলো যে তা শেষ ১০ দিনে। সুতরাং তোমাদের মধ্যে যে ইতিকাফ পছন্দ করবে, সে যেন ইতিকাফ করে।’ এরপর মানুষ তাঁর সঙ্গে ইতিকাফে শরিক হয়। (মুসলিম)
বিশেষ করে রমজানের শেষ দশকের বিজোড় রাতগুলোতে শবে কদর অন্বেষণের তাগিদ দেওয়া হয়েছে। উম্মুল মুমিনিন হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তোমরা রমজানের শেষ দশকের বিজোড় রাতে শবে কদরের সন্ধান করো।’ (বুখারি ও মুসলিম)
বিশিষ্ট সাহাবি হজরত আবু বাকরা (রা.)-এর কাছে একবার শবে কদর সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলো। তিনি বললেন, ‘শবে কদর রমজানের শেষ ১০ দিন ছাড়া অন্য কোনো রাতে আমি অনুসন্ধান করব না।’ অর্থাৎ, শবে কদর প্রতিবছর একই রাতেও হতে পারে, আবার বিভিন্ন রাতেও হতে পারে। হতে পারে এক বছর ২১ তারিখে, আরেক বছর ২৩ তারিখে, অন্য আরেক বছর ২৫, ২৭ বা ২৯ তারিখে। প্রকৃত তারিখ আল্লাহ তাআলাই ভালো জানেন।
শবে কদরের আমল
শবে কদরের ইবাদত অন্য যেকোনো রাতের চেয়ে বেশি সওয়াবের। এ রাতে আল্লাহ তাআলা বান্দার গুনাহ মাফ করেন। রহমতের দরজা খুলে দেন। হজরত নবী করিম (সা.) বলেন, ‘যে ইমান ও ইহতিসাবের সঙ্গে (আল্লাহর সন্তুষ্টি ও সওয়াবের আশায়) কদরের রাতে ইবাদত করে, তার অতীতের সব গুনাহ মাফ করে দেওয়া হয়।’ (বুখারি ও মুসলিম)
আর শবে কদরের নির্দিষ্ট কোনো তারিখ যেহেতু নেই, তাই রমজানের শেষ দিকে বেশি বেশি আমল করা উচিত। বিশেষ করে নফল নামাজ যেমন তাহাজ্জুদ, সালাতুত তাসবিহ, তাওবার নামাজ, সালাতুল হাজত, সালাতুশ শোকর ইত্যাদি আদায় করা, পবিত্র কোরআন তিলাওয়াত করা, আত্মীয়স্বজনের কবর জিয়ারত করা, জিকির-আজকার, দান-খয়রাত, দোয়া করা ইত্যাদি।
এ ছাড়া তওবা-ইস্তেগফার করার কথাও হাদিসে এসেছে। হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, একবার আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ওগো আল্লাহর রাসুল, আপনি বলে দিন—যদি আমি জানতে পারি, শবে কদর কোন রাতে হবে, তাহলে আমি কী পড়ব?’ রাসুল (সা.) বললেন, ‘তুমি পড়বে, ‘আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুউন তুহিব্বুল আফওয়া ফাফু আননি।’ অর্থাৎ ‘হে আল্লাহ, তুমি ক্ষমাশীল, ক্ষমা করতে ভালোবাসো। অতএব, আমাকে ক্ষমা করো।’ (সুনানে তিরমিজি)
শবে কদর চিনব যেভাবে
মহিমান্বিত ও বরকতময় রাত শবে কদর সন্ধ্যা থেকে ফজর পর্যন্ত পুরোটাই গুরুত্বপূর্ণ। শবে কদর চেনার কিছু আলামত হাদিসে বর্ণিত হয়েছে। এ রাতে চাঁদ হবে উজ্জ্বল। জ্যোৎসনায় আলোকিত থাকবে চারপাশ। রাতটি হবে শান্তিপূর্ণ ও শান্তিদায়ক। মৃদ বাতাসে হৃদয় জুড়িয়ে দেবে। আকাশ পরিষ্কার ও নির্মল থাকবে। সকালে সূর্য উদয় হবে নিস্তেজ ও লালচে আভা নিয়ে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘শবে কদরের আলামত হচ্ছে, স্বচ্ছ রাত—যে রাতে চাঁদ হবে উজ্জ্বল। আবহাওয়ায় প্রশান্তিময়তা থাকবে—বেশি ঠান্ডাও না, বেশি গরমও না। সকাল পর্যন্ত আকাশে কোনো উল্কাপিণ্ড দেখা যাবে না। ওই রাতের চাঁদের মতো সকালে সূর্য উঠবে (তীব্র) আলোকরশ্মি ছাড়া।’ (মুসনাদ আহমদ: ২২৭৬৫)
হজরত উবাই ইবনে কাব (রা.) বলেন, ‘আর ওই রাতের আলামত হলো—দিনের সূর্য উদিত হয় উজ্জ্বল হয়ে, তাতে (আলোর) তীব্রতা থাকে না।’ (সহিহ মুসলিম: ১৬৫৮)
এসব আলামত বিশ্লেষণ করেও বোঝা যায়, আগে থেকেই শবে কদর সুনির্দিষ্টভাবে চেনার কোনো উপায় নেই। সুতরাং রমজানের শেষ দশকে নিরবচ্ছিন্নভাবে আল্লাহর ইবাদতে মশগুল হওয়াই শবে কদর অনুসন্ধানের শ্রেষ্ঠ উপায়।