হোম > ইসলাম

কোরআনের আলো বিলাচ্ছেন দৃষ্টিহীন হাফেজ রুমান

হারুনূর রশিদ, রায়পুরা (নরসিংদী)

আপডেট: ১০ জানুয়ারি ২০২৫, ০৮: ৪৯
দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী দুই শিক্ষার্থীকে পড়াচ্ছেন অন্ধ হাফেজ রুমান। ছবি: আজকের পত্রিকা

প্রবল ইচ্ছাশক্তি ও দৃঢ় মনোবলের কাছে যে সব প্রতিবন্ধকতা হেরে যায়, তারই উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী হাফেজ মুহাম্মদ রুমান। ৪০-এর ঘর স্পর্শ করা এ হাফেজ রুমান নরসিংদীর রায়পুরার মাহমুদাবাদ এলাকার মৃত মগল গাজীর ছেলে। রুমানের চোখে আলো না থাকলেও নিজেই মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করে বিনা পারিশ্রমিকে হাজার হাজার ছাত্রের মধ্যে পবিত্র কোরআনের আলো বিলিয়ে যাচ্ছেন। ইতিমধ্যে শতাধিক ছাত্রকে হাফেজও বানিয়েছেন তিনি।

ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের পাশে মাহমুদাবাদ এলাকায় অবস্থিত হাফেজ রুমানের হাতে-গড়া প্রতিষ্ঠান মাহমুদাবাদ মগল গাজী ইসলামিয়া মাদ্রাসা ও এতিমখানাটি অনেকটা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়েই চলছে। জানা যায়, রুমান স্থানীয় দরিদ্র কৃষক পরিবারে ১৯৮৪ সালে জন্মগ্রহণ করেন। মাত্র দেড় বছর বয়সে টাইফয়েড জ্বরে চোখের আলো হারান। শৈশব-কৈশোর পেরোনোর পরই লেখাপড়ার ইচ্ছে জাগে রুমানের। প্রথমে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী স্কুলে লেখাপড়া শুরু করেন। ধর্মীয় মূল্যবোধ থেকে স্কুলে গানবাজনা ভালো না লাগায় ছুটি নিয়ে বাড়ি চলে আসেন। বাড়ি এসে স্কুলশিক্ষকের কাছে স্কুলে না যাওয়ার কারণ জানিয়ে চিঠি লেখেন।

বাবা মগল গাজীও চাইতেন, ছেলে কোরআনে হাফেজ হবে। বাবার ইচ্ছেপূরণে এক হিতাকাঙ্ক্ষীর পরামর্শে ঢাকার একটি মাদ্রাসায় ভর্তি হন রুমান। ব্রেইল পদ্ধতিতে ৩০ পারা কোরআন মুখস্থ করে হাফেজ হন। কম বেতনে বিভিন্ন মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করে শতাধিক হাফেজ গড়ে তুলেছেন। ইতিমধ্যেই তাঁর পাঁচ-সাতজন প্রতিবন্ধী ছাত্র হাফেজ হয়ে বিভিন্ন মাদ্রাসায় শিক্ষকতায় নিয়োজিত হয়েছেন।

২০১৬ সালে ভাইদের সহযোগিতায় বাবার রেখে যাওয়া ১৫ শতাংশ জমিতে মগল গাজী ইসলামিয়া মাদ্রাসা ও এতিমখানা প্রতিষ্ঠা করেন। মাদ্রাসার প্রধান মুহতামিম রুমান নিজেই। তিনি ছাড়াও রয়েছেন তিনজন শিক্ষক। মাদ্রাসায় রয়েছে দুটো টিনশেড ঘর, মসজিদ, অজুখানা, গোসলখানা, শৌচাগার, টিউবওয়েল। মাদ্রাসার পক্ষ থেকেই বিনা মূল্যে শিক্ষার্থীদের খাবার, নাশতা, জামাকাপড়—সবই দেওয়া হয়। প্রতিষ্ঠানটি মানুষের দান-সদকা ও আর্থিক সহযোগিতার মাধ্যমে পরিচালিত হয়।

মাদ্রাসার দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীরা বলেন, ‘বড় হুজুরের সার্বিক সহযোগিতার কারণেই আমরা পড়াশোনা করতে পারছি। বড় হুজুরের তুলনা নাই। আমরাও তাঁর মতো অন্যের মাঝে জ্ঞানের আলো ছড়াতে চাই।’

মাদ্রাসার আরেক শিক্ষার্থী জানান, ‘দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ভাইদের সঙ্গে পড়তে পেরে খুব আনন্দ পাই। অন্ধরা যখন প্রথমে মাদ্রাসায় পড়তে আসেন, তখন তাঁদের কিছুটা কষ্ট হয়। পরে খাওয়া, গোসল, শৌচকর্ম, চলাফেরা ও মসজিদে নামাজ আদায়—সবই নিজে নিজে করতে শিখে গেছেন।’

মাহমুদাবাদের স্থানীয় বাসিন্দা সোলায়মান ভূঁইয়া বলেন, ‘এই মাদ্রাসায় আমার দুই সন্তানকে হাফেজ হতে দিয়েছি। হাফেজ রুমান দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী হয়েও ছাত্রদের মাঝে জ্ঞানের আলো বিলিয়ে যাচ্ছেন। তাঁকে নিয়ে আমরা খুবই গর্বিত। তিনি নিজের জন্য কিছুই করছেন না; সবই অন্যের জন্য বিলিয়ে যাচ্ছেন। কষ্ট করে মাদ্রাসাটি পরিচালনা করে যাচ্ছেন; সরকারি-বেসরকারি সহযোগিতা পেলে মাদ্রাসাটি এগিয়ে যাবে।’

একই এলাকার সাইফুদ্দীন বলেন, ‘অন্ধরা হাতে ধরে পড়াশোনা করে দেখে আরচাইজ্জ (আশ্চর্য) লাগে। এখানে আসলে মন ভালো হয়ে যায়। তিনি অন্ধ হয়েও কী সুন্দরভাবে মাদ্রাসা পরিচালনা করে যাচ্ছেন। দূর-দূরান্ত থেকে আসা ছাত্ররা পড়াশোনা করছে, এটা দেখে আনন্দ লাগে। অনেকে মাদ্রাসাটির কথা শুনে আসেন।’

হাফেজ রুমান আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আশপাশের কয়েক জেলায় দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের জন্য স্কুল থাকলেও কোনো মাদ্রাসা নেই। অন্ধদের ধর্মীয় শিক্ষার কথা চিন্তা করেই ৮ বছর আগে আমি মাদ্রাসাটি প্রতিষ্ঠা করি। বর্তমানে মাদ্রাসায় ৫০ জন শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে। এর মধ্যে ৭ জন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী এবং বাকিরা এতিম-অসহায়। স্ত্রী, এক ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়েই আমার সংসার। মাদ্রাসার নির্ধারিত কোনো ফান্ড না থাকায় অর্ধশতাধিক ছাত্রকে পড়াতে ও মাদ্রাসা চালাতে কষ্ট হচ্ছে।’

উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা খলিলুর রহমান বলেন, ‘রুমানের এ কাজ সমাজকে এগিয়ে নেওয়ার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তিনি যা করে যাচ্ছেন, খুবই প্রশংসনীয় উদ্যোগ।’ সরকারি নিয়মমাফিক আবেদন করা হলে তাঁর প্রতিষ্ঠানকে সার্বিক সহায়তা করার আশ্বাসও দেন তিনি।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, সংবাদমাধ্যম বা যেকোনো মাধ্যমে প্রচারিত কোনো ছবি, ভিডিও বা তথ্য বিভ্রান্তিকর মনে হলে তার স্ক্রিনশট বা লিংক কিংবা সে সম্পর্কিত বিস্তারিত তথ্য আমাদের ই-মেইল করুন। আমাদের ই-মেইল ঠিকানা factcheck@ajkerpatrika.com

নবীজির শানে শব্দ প্রয়োগে সতর্কতা

তীব্র শীতে মুমিনের অনুভব ও দোয়া

হাঁচির সময়ের তিনটি দোয়া