উদ্ভিদ সাম্রাজ্যে মাশরুম হচ্ছে এক ধরনের ছত্রাক। প্রাচীনকাল থেকে মানুষ মুখোরোচক খাবার হিসেবে অনেক গুণের আধার এই মাশরুমকে তাদের বিচিত্র খাবারের তালিকায় অনেকটা প্রাধান্য দিয়েই স্থান দিয়েছে। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে এর জনপ্রিয়তা ও চাহিদা।
এর কারণও আছে। মাশরুম ক্যালরি ও প্রচুর আঁশযুক্ত (বিটা গ্লুকান) সহজ পাচ্য ও প্রাকৃতিকভাবে গ্লুটেন মুক্ত। এটি শরীরের জন্য উপকারী আমিষ, খাদ্যপ্রাণ অর্থাৎ ভিটামিন ও বিভিন্ন খনিজ সমৃদ্ধ একটি চমৎকার খাবার। এতে শর্করা ও স্নেহ বা তেল জাতীয় উপাদান পরিমাণে খুব কম থাকে বলে যারা মোটেই মুটিয়ে যেতে চান না, তাঁরা নির্দ্বিধায় মাশরুমের মজার স্বাদ নিতে পারেন। তা ছাড়া এর গ্লাইসেমিক ইনডেক্স (জিআই) নিচের দিকে। মাশরুম পটাশিয়ামের ভালো উৎস। এটি উচ্চ রক্তচাপ ও টাইপ-২ ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করে। হৃদ্রোগ প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে। রক্তস্বল্পতা নিরাময়সহ হাড় ও দাঁতকে শক্ত করে। আর অকালে চুল পাকা ও চুলপড়া রোধ করে। শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা শক্তিশালী করে। এক কথায় মাশরুমের যেমন রয়েছে চমৎকার পুষ্টিগুণ, ঠিক তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আছে অসাধারণ ঔষধিগুণ।
বর্তমানে বিশ্বের ৬০টি দেশে প্রায় ২০ প্রজাতির মাশরুমের চাষ হয়ে থাকে। তবে কিছু মাশরুম আছে, যা বাণিজ্যিকভাবে চাষ করা আজও সম্ভব হয়নি। আর তাই খাবার প্লেটে জোগান দিতে নির্ভর করতে হয় প্রকৃতির ওপর। স্বাদে, গন্ধে ও পুষ্টিগুণে অতুলনীয় এমন পাঁচটি প্রাকৃতিক মাশরুমের সঙ্গে পরিচিত হওয়া যাক।
ট্রাফল
মাশরুমের জগতে বিস্ময় এ মাশরুমের বৈজ্ঞানিক নাম ‘টিউবার মেলানোস্পোরাম’। আরেকটি নাম ‘কালো হিরা’। প্রতি কেজির দাম ৫০০ থেকে ১ হাজার ইউরো (বর্তমান বিনিময় মূল্য অনুযায়ী ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা)। দামের কারণেই এর এমন নাম হয়েছে। সুস্বাদু ও সুগন্ধযুক্ত অত্যন্ত বিরল এই মাশরুম ইউরোপে, বিশেষ করে ফ্রান্স ও ইতালিতে পাওয়া যায়। যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও চীনেও পাওয়া যায় এটি। মাটির নিচে জন্মে। তাই ট্রাফল খোঁজার জন্য প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কুকুর বা শূকর ব্যবহার করা হয়। এ মাশরুমের বেশ কয়েকটি ধরন আছে। এর মধ্যে মাখন রঙা ট্রাফলের মূল্য আকাশচুম্বী—৫ হাজার থেকে ৭ হাজার ইউরো প্রতি কিলোগ্রামের দাম। অভিজাত রেস্তোরাঁতে শেফরা বিভিন্ন খাবারের সঙ্গে কাঁচা অথবা রান্না করা ট্রাফল ব্যবহার করেন। এ ছাড়াও সস ও স্যুপ তৈরি হয় এটি দিয়ে।
বন্য মাশরুমের মধ্যে এটি জনপ্রিয়। গরমের দিনগুলোতে ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার বনে বাদাড়ে বেড়াতে গেলে উজ্জ্বল সোনালি রঙের এমন মাশরুমের দেখা মিলে যেতে পারে। ষোলো শতক থেকে ইউরোপে, বিশেষ করে ফরাসিদের খাবার টেবিলের দখল নিতে শুরু করে এটি। আঠারো শতকে অনেকটাই শৌখিন ও অভিজাত খাদ্য রসিকদের রসনার দখল নিয়ে ফেলে স্যান্টেরেল। এপ্রিকটের হালকা ঘ্রাণযুক্ত এ মাশরুম মাছ, মাংসের সঙ্গে রান্না করা যায়। তাতে খাবারে হালকা মিষ্টি একটি ঘ্রাণ হয়। রুচি বৃদ্ধির জন্য চমৎকার কাজ করে এটি। এ ছাড়াও স্যান্টেরেল পুষ্টিগুণে অনন্য। উজ্জ্বল কমলা-সোনালি রঙের কারণে অনেক শেফ নান্দনিক সৌন্দর্য বাড়ানোর জন্য খাবার সাজাতে স্যান্টেরেল ব্যবহার করে থাকেন। ফরাসি রন্ধনশৈলীর অংশ হিসেবে বর্তমানে বহু দেশে সমাদৃত এটি।
ইংরেজরা এ মাশরুমের নাম দিয়েছে ‘সুইট টুথ’। এদিকে ইংরেজরা যা করে ফরাসিরা প্রায়ই তার উল্টোটা করে। সে জন্য তারা এর নাম রেখেছে ‘মেষের পা’। নামের এমন বিবাদ ভঞ্জন করতে উদ্ভিদবিজ্ঞানীরা এর নাম দিয়েছেন ‘হাইডনাম রিপানডাম’। হালকা মিষ্টি এবং কিছুটা বাদামের মতো স্বাদের কমলা, হলুদ বা ট্যান রঙের ক্যাপের এ মাশরুম শরৎ কালে পাওয়া যায় ইউরোপে। মাছ-মাংসের সঙ্গে এ মাশরুমের স্বাদ আস্বাদন করতে অনেকেই খুব আগ্রহী হন। জলপাই তেলে হালকা ভাজিও খুব ভালো লাগবে।
বিজ্ঞানীরা এর একটি খটমটো নাম দিয়েছেন—‘বোলেটাস এডুলিস’। একটি চমৎকার মাংসল মাশরুম। পৃথিবীর উত্তর গোলার্ধে জন্মে। আর তাই ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকাতে সুলভ না হলেও মোটেই দুর্লভ নয়। নাদুসনুদুস এবং ছাতার আকারের ক্যাপের জন্য সহজেই চেনা যায় একে। নিম্ন তাপমাত্রায় সংরক্ষণ সহজ বলে সব মৌসুমে কিনতে পাওয়া যায়।
খাদ্যপ্রাণ ছাড়াও চমৎকার সেলেনিয়াম, ম্যাংগানিজ, দস্তা, তামা, আয়োডিন ও মলিবডেনামের মতো খনিজ উপাদানের উৎস বলে ইউরোপীয়দের খুব প্রিয় এই ছেপ। খানিকটা পার্সলে আর রসুন বাটা দিয়ে অলিভ তেলে খুব সহজেই ভাজি করা যায়। ডিম ভাজিতে খেতে অনেকেই খুব পছন্দ করেন। তা ছাড়া ছেপ দিয়ে বেশ কয়েক পদের মজাদার সস এবং স্যুপ তৈরি করা যায়।
শেফদের খুব প্রিয় একটি মাশরুম। রন্ধনশৈলীকে আলাদা মাত্রা দিতে তাঁরা এই মাশরুমকে বেছে নেন। সুপার শপে, গ্রোসারিগুলোতে শুকনো সংরক্ষিত মোরেল পাওয়া যায়। মোরেল ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকাতে মার্চ থেকে জুন মাস পর্যন্ত দেখা যায়। রান্নার পর বেশ মোলায়েম স্বাদের হয় এটি, তবে মুখে দিলে গলে যায় না। ফলে বেশ তৃপ্তিদায়ক। চমৎকার ঘ্রাণের কারণে মোরেলকে আলাদা করা যায়। মাখন দিয়ে রান্না করা বাচ্চা গরু কিংবা মুরগির মাংসে আলাদা ব্যঞ্জনা জোগাতে মোরেলের জুড়ি মেলা ভার। অ্যাসপারাগাস বা বসন্তকালীন শাকসবজির সঙ্গে খানিকটা মাখন দিয়ে ভাজি করা তাজা মোরেলের স্বাদ অনেক দিন মনে থাকার কথা।
তবে মাশরুম চিনতে হবে। কিছু কিছু মাশরুম খুবই বিষাক্ত হয়ে থাকে। আর কিছু মাশরুম আছে মাদকের মতো কাজ করে, হ্যালুসিনেশন সৃষ্টি করে। তাই না জেনে, না চিনে মোটেই মাশরুম খাওয়া যাবে না।
মইনুল হাসান: ফ্রান্স প্রবাসী লেখক ও গবেষক