১৯৫২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি, একটি বিশেষ বিমান কেনিয়ার রাজধানী নাইরোবি থেকে লন্ডনের পথে উড়ে যাচ্ছে। যাত্রীদের সবার মুখেই বিষণ্নতার কালো ছায়া, কেউ তেমন কথা বলছেন না। পাইলট থেকে শুরু করে স্টুয়ার্টদের মুখের চিরাচরিত হাসি বিষণ্নতায় ঢাকা পড়েছে। বিমানের একটানা যান্ত্রিক আওয়াজ অনেকটা একঘেয়ে হয়ে এসেছে। সেই আওয়াজ ছাপিয়ে কান্নার মৃদু আওয়াজ পরিবেশকে আরও ভারী করে তুলেছে। ব্যক্তিগত কেবিনে, সবার চোখের আড়ালে পঁচিশ বছরের এক তরুণী কাঁদছেন। তিনি তাঁর পিতার মৃত্যুর খবর পেয়ে লন্ডনে ফিরে যাচ্ছেন। শুধু তাঁর পরিবারের সদস্যরাই নন, সমগ্র দেশবাসী অধীর আগ্রহে তাঁর জন্য অপেক্ষা করছে। পিতা রাজা ষষ্ঠ জর্জের মৃত্যুর পর তিনিই সে দেশের এবং আরও ৩১টি সার্বভৌম রাজ্যের সিংহাসনের উত্তরসূরি। তাঁর পুরো নাম এলিজাবেথ আলেকজান্ড্রা ম্যারি। মা আদর করে ডাকতেন ‘লিলিবেট’।
লন্ডন বিমানবন্দরে পৌঁছালে কালো রঙের গালিচায় তাঁকে অভ্যর্থনা জানানো হয়। বিমানবন্দরে উপস্থিত ছিলেন আরেক কিংবদন্তি, যুক্তরাজ্যের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল।
১৯৫৩ সালের ২ জুনের অভিষেক অনুষ্ঠানে ২ হাজার ৮৬৮টি হীরকখচিত ১ কিলোগ্রাম বা ২ দশমিক ২ পাউন্ড ওজনের রাজমুকুট তাঁর মাথায় উঠলেও, ১৯৫২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি ঘড়ির কাঁটায় যখন বেলা ১১টা বেজে ১৫ মিনিট, তখন থেকে একনাগাড়ে সত্তর বছর রানির দায়িত্ব পালন করেছেন।
রাজতন্ত্রের প্রতি বিদ্বেষ ভাব থাকলেও ফরাসিরা পাশের দেশের রানিকে বেশ পছন্দ করে। রানি চমৎকার ফরাসি বলতে পারেন। সে কারণেও ফরাসি জনগণ সব সময়ই তাঁর প্রতি একধরনের নৈকট্য, আকর্ষণ অনুভব করত। বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধান, নামকরা সব মানুষ রানির চমৎকার ব্যক্তিত্ব, প্রজ্ঞা, গভীর কর্তব্যবোধ, চারিত্রিক দৃঢ়তা ও উদারতায় মুগ্ধ হয়ে তাঁর প্রশংসায় প্রায়ই পঞ্চমুখ হয়েছেন। অনেকটা অলিখিত প্রথার মতো ফ্রান্স ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র—এ দুই দেশের প্রেসিডেন্টরা একবার হলেও তাঁর সাক্ষাৎ প্রার্থনা করেছেন।
ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট রেনে কোটি, শার্ল দ্য গোল থেকে শুরু করে আজকের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাখোঁসহ মোট ৯ জন ফরাসি প্রেসিডেন্টের স্মৃতির অ্যালবামে ইতিহাস হয়ে আছে রানির ঝলমলে সব ছবি। এর সঙ্গে আছে কিছু কিছু কাহিনি।
রানি শার্ল দ্য গোলকে খুব পছন্দ করতেন। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে নাৎসি বাহিনী ফ্রান্স দখল করে নিলে ১৯৪০ সালের ১৮ জুন লন্ডন থেকে জেনারেল দ্য গোল রেডিওতে ফরাসি জনগণকে শত্রুসৈন্যের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে আহ্বান জানান। সে সময় তাঁর রেডিও বার্তাটিতে বারুদের মতো জ্বলে উঠেছিল ফরাসি জনগণ। দখলদার বাহিনী হটিয়ে মাতৃভূমি উদ্ধারের জন্য দেশের আনাচে-কানাচে মুক্তিযোদ্ধারা সংগঠিত হয়েছিল এবং নাৎসি বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। পরবর্তী সময়ে দ্য গোল ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট হলে রানির সঙ্গে দেখা করেন।
প্রেসিডেন্ট ভ্যালেরি জিস্কার-ডেসতাকে (১৯৭৪-১৯৮১) রানি তাঁর প্রিয় একটি কুকুর উপহার দিয়েছিলেন। রাতারাতি ভাগ্যবান কুকুরটির ছবি ফ্রান্সের সব কটি প্রচারমাধ্যমে বেশ গুরুত্বের সঙ্গে প্রচারিত হয়। কুকুরটি কী বুঝেছিল, তা কেউ না বলতে পারলেও প্রেসিডেন্ট জিস্কার-ডেসতা খুব আনন্দিত এবং গর্বিত হয়েছিলেন।
প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া মিতেরা দুই মেয়াদে ১৪ বছর (১৯৮১-১৯৯৫) ক্ষমতায় ছিলেন। মিতেরার সঙ্গে রানির বেশ সখ্য ছিল। তাঁদের অনেকবার দেখা হয়েছিল। ইতিহাস ছিল তাঁদের প্রিয় আলোচনার বিষয়।
রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ ছিলেন এমন একজন রাষ্ট্রপ্রধান, যার সঙ্গে দেখা হয়েছে পৃথিবীর বহু নামকরা ব্যক্তির। তাঁর সামনে আচার-আচরণে সতর্ক হতে হতো অন্য সব দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের। রানির মতো জৌলুশ, সম্মান, অভিজ্ঞতাসমৃদ্ধ ও আড়ম্বরপূর্ণ দীর্ঘ জীবন আর কোনো রাষ্ট্রপ্রধানের ভাগ্যে জোটেনি।
মানুষের জন্ম হয় মৃত্যুকে মাথায় নিয়েই। তবে কে কত দিন পৃথিবীর আলো দেখবে তা আগে থেকে কেউ বলতে পারে না। রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ, তিনিও জন্মেছিলেন যেদিন, সেদিন থেকেই তাঁর মৃত্যু অবধারিত ছিল। গত ২১ এপ্রিল ৯৬ বছর পার করে আরও ১৩৯ দিন বেঁচে ছিলেন তিনি। খুব কম মানুষই ৯ দশকের বেশি আয়ু পায়। সে হিসাবে তাঁর এমন মৃত্যু, তাঁকে অনেক বেশি ভাগ্যবানদের দলেই ফেলেছে। তাঁর বর্ণাঢ্য জীবনকালেই তিনি পরিণত হয়েছিলেন কিংবদন্তিতে। যে সাম্রাজ্যে সূর্য অস্ত যায় না, তিনি ছিলেন সেই সাম্রাজ্যের সিংহাসনে আসীন একনাগাড়ে সত্তর বছর, গুনে গুনে সাত দশক। কোনো মানুষই সমালোচনার ঊর্ধ্বে নয়। সবচেয়ে ভালো মানুষটিরও খুঁত ধারার মানুষের অভাব হয় না। তার পরও লিলিবেট নামের আড়ালে রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ অনেক বেশি নন্দিত। লিলিবেট মারা গেছেন পৃথিবী কাঁপিয়ে, কাঁদিয়ে।
লেখক : ফ্রান্সপ্রবাসী লেখক।