ঠোঁটে টকটকে লাল বা উজ্জ্বল কমলা রঙা লিপস্টিক। মাথার ওপর তুলে রাখা বিনুণীতে গেঁথে রাখা আছে গোলাপি, হলুদ, লাল ফুল। কখনো বা ফুলের পরিবর্তে শোভা পাচ্ছে সিল্কের রঙিন ফিতে। পুরু জোড়া ভ্রুর নিচে বুদ্ধিদীপ্ত চোখ দুটি হারিয়ে গেছে যেন দিগন্তের শেষ সীমানায়। গোটা আকাশটাই তাঁর কাছে জীবন্ত এক ক্যানভাস। গলায় জড়ানো লালচে ওড়নাটির মতোই যেন উড়ে আসা ছাই বা বেগুনিরঙা মেঘ ভাসিয়ে ছবি এঁকে ফেলেন মনের অজান্তেই।
মেক্সিকান চিত্রশিল্পী ফ্রিদা কাহলো নিজেই যেন এক পটে আঁকা ছবি। কে না চেনে তাঁকে? তাঁর চিত্রকর্ম তো বটেই, পাশাপাশি তাঁর ব্যতিক্রমধর্মী ফ্যাশন স্টাইল তাঁকে বরাবরই আলাদা করে তুলেছে। ২০২১ সালে এসেও ফ্যাশন সচেতন তরুণীদের অনুপ্রাণিত করছেন তিনি। ফ্রিদা স্টাইলের হেয়ারব্যান্ড আর কুচি ঘেরা প্রিন্টের স্কার্ট এখন নারীদের ওয়ার্ডরোবে শোভা পাচ্ছে।
ফ্রিদা কাহলোর জীবন ও কর্ম এক কথায় বর্ণাঢ্য। জীবনের পরতে পরতে গহিন রহস্য, আচ্ছন্নতা, চাপা বেদনা ও প্রতিবন্ধকতাকে সঙ্গী করেই তিনি হয়ে উঠেছেন অন্যতম শ্রেষ্ঠ এক চিত্রশিল্পী ও ফ্যাশন আইকন। ফ্রিদা এমন পোশাক পরতে পছন্দ করতেন, যা তাঁর ব্যক্তিত্বকে ফুটিয়ে তোলে। পাশাপাশি তাঁর পোশাক ও স্টাইল ছিল তাঁর রাজনৈতিক একাত্মতার অংশবিশেষ।
এখানেই শেষ নয়। আঠারো বছর বয়সে কাহলোকে আরেকটি বড় ধরনের ধকল সইতে হয়। এক বাস দুর্ঘটনায় তাঁর মেরুদণ্ডের দিকের প্রায় ২০টি হাড় ভেঙে যায়। এই দুর্ঘটনার পর প্রায় ত্রিশবার অপারেশন করাতে হয় তাঁকে। এ ছাড়া ডান পা কেটে ফেলার পর বিখ্যাত এই চিত্রশিল্পীকে মৃত্যু অবধি টেনে যেতে হয়েছিল শারীরিক নানা প্রতিবন্ধকতা। একটু সেরে ওঠার পর ফ্রিদা পেইন্টিং করতে শুরু করেন। এ সময় তাঁর পোশাকেও আসে পরিবর্তন। ফ্রিদা কাহলো যে ধরনের পোশাক পরতেন, তার পেছনে দুটো কারণ ছিল। প্রথমত, তিনি এমন পোশাক পরতে চাইতেন, যা তাঁর শারীরিক অক্ষমতাকে ঢেকে রেখে স্বকীয়তা বজায় রাখবে। দ্বিতীয়ত, এটি তাঁর মৌলিক রাজনৈতিক বিশ্বাসকেও সমানতালে প্রদর্শন করবে।
বামপন্থী কাহলো ১৬ বছর বয়সে সমাজতান্ত্রিক দলে এবং বিশ শতকের গোড়ার দিকে ম্যুরালিস্ট ডিয়েগো রিভেরাসহ মেক্সিকো কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিয়েছিলেন। ১৯২৯ সালে তিনি রিভেরাকে বিয়ে করেন।
তেহুয়ানা পোশাককে নতুন করে পরার জন্য ফ্রিদার কাছে আরও একটা কারণ ছিল। কাহলোর শারীরিক গঠন ছিল অনেকটাই ভঙ্গুর। তেহুয়ানা পোশাক তাঁর শারীরিক গঠনকে ঢেকে রাখত ভালোভাবে। যখন তিনি হাঁটতেন, তখন পায়ের কাছ থেকে তাঁর পোশাকের পরতগুলো এমনভাবে ডানে–বামে ছড়িয়ে পড়ত যে, তাঁর দুই পায়ের অসামঞ্জস্যতা বোঝা যেত না। তা ছাড়া তাঁর ব্লাউজগুলোর কাটিং ও বুকের কাছে বাক্স আকৃতির নকশা তাঁর শরীরের ভঙ্গুরতাকে আড়াল করত। এ পোশাক বসে ছবি আঁকার সময়ও আঁটসাঁট হতো না।
উল্লেখ করাই হয়েছে, কাহলোর স্টাইলে ছিল নিজস্বতা। তাঁর গয়নাগুলোয় ছিল নিজের যোগ করা উপাদান ও নকশা, রাজনৈতিক প্রতীক। শুধু তাই নয়, নিজের বুটে তিনি নিজেই লেস লাগাতেন। ফ্রিদা তাঁর চিত্রকর্ম ও পোশাক উভয় ক্ষেত্রেই ছিলেন চিন্তাশীল ও স্বতন্ত্র।
এই অসাধারণ শিল্পীর জীবনের শুরুই হয়েছিল নানা প্রতিকূল ঘটনা দিয়ে। তবে সবটা নিয়েই তিনি ছিলেন অনন্য। কাহলোর পোশাক শারীরিক প্রতিবন্ধকতাকে ঢাকার বদলে তাঁকে দিয়েছিল এক অসীম শক্তি।