পাট ও পাটজাত পণ্য বাঙালি যাপনের বহু প্রাচীন অনুষঙ্গ। ব্রহ্মপুত্র-যমুনা অববাহিকায় পাট চাষের ইতিহাস বেশ পুরোনো। পুরো দেশে উৎপাদিত বিপুল পরিমাণ পাট বাঙালিরা ব্যবহার করে তাদের দৈনন্দিন ব্যবহারের বিভিন্ন পণ্য তৈরিতে। সেসব পণ্যের মধ্যে রয়েছে পাটের দড়ির মতো প্রয়োজনীয় জিনিস ও শিকার মতো শৌখিন জিনিসও। একটি প্রয়োজন মেটায়, অন্যটি প্রয়োজন ছাড়াও মেটায় সৌন্দর্যবোধ। এ দুইয়ের মাঝামাঝি রয়েছে ধোকড়ার মতো পণ্য, যেগুলো একাধারে শীত নিবারণ ও সামাজিকতার কাজেও ব্যবহার করা হয়।
পাটপণ্য দিয়ে বাজার মাত করার চিন্তা প্রথম করেন ব্রিটিশ উদ্যোক্তা জর্জ অকল্যান্ড। পাটের তৈরি পণ্যের বাজার বাড়াতে তিনি চালু করেন অকল্যান্ড মিল নামে ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম জুট মিল। চালু হয় কলকাতার হুগলিতে, ১৮৫৫ সালে। সেখানে তৈরি করা হতো পাটের মোটা সুতা বা সুতলি। এরপরেই পাটের বৈচিত্র্যময় পণ্য তৈরি হতে শুরু করে। এর একটি হলো চটের বস্তা। ঠিক কত কোটি বেল পাটের তৈরি বস্তা বাঙালির বাড়িতে ব্যবহার করা হয়েছে, তার কোনো হিসাব নেই। আর রপ্তানির হিসাব রাখা বাঙালির ধাতে নেই বলে সে তথ্যও প্রায় নেই বললেই চলে।
একসময় চাল ও গম নেওয়ার জন্য বস্তা বানানো হতো পাটের আঁশ দিয়ে। এখন আমাদের দেশে প্রায় আড়াই শর বেশি পাটপণ্য তৈরি হয়। এর মধ্যে শুধু ব্যাগই তৈরি হয় ৫৭ রকমের।
পাটের আঁশের সবচেয়ে বড় সুবিধা হচ্ছে, এটি যেকোনো ধরনের সুতার সঙ্গে মেশানো যায়। পরিবেশবান্ধব, যত্নআত্তির প্রয়োজন কম, দামে সস্তা, দীর্ঘস্থায়ী বলে পাটপণ্যের কদর আছে গ্রামীণ ও শহুরে মধ্যবিত্ত সমাজে। এর বড় উদাহরণ ব্যাগ ও বস্তা। একসময় বাজারের ব্যাগ বলতেই ছিল চটের ব্যাগ। পলিথিনের ব্যাগ আসার পর তাতে কিছুটা ভাটা পড়ে।
গয়না-শাড়ি ও অন্যান্য
রঙিন চুড়ি শুধু কাচেরই হয় না। এখন পাটের আঁশেরও চুড়ি তৈরি হয়। তৈরি হয় গলার মালা। সুতি কাপড়ের সঙ্গে পাটের আঁশ মিশিয়ে তৈরি হয় জুট-কটন শাড়ি। গঙ্গা যমুনা পাড়ওয়ালা শাড়িগুলোর দামও হাতের নাগালে। জুট কাতানের দাম একটু বেশি।
পাটকাঠি দিয়ে চুলা জ্বালিয়ে রান্না করা কিংবা বাড়ির বেড়া তৈরির প্রচলন আমাদের দেশে অনেক প্রাচীন। আধুনিককালে পাটকাঠির ছাই দিয়ে তৈরি হচ্ছে সৌন্দর্যচর্চার পণ্য। পাটকাঠির ছাই থেকে তৈরি হয় অ্যাকটিভেটেড কার্বন। ফেসওয়াশ বা ফেস মাস্ক শিটে উপাদানটি ব্যবহৃত হয়। ত্বক থেকে ময়লা টেনে তুলতে এর জুড়ি নেই।
পাটের বহুমুখী ব্যবহার নিয়ে কথা বলেছেন জুট ডাইভারসিফিকেশন প্রমোশন সেন্টার (জেডিপিসি)-এর লিয়াজোঁ অফিসার মোহাম্মদ আলী। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে যখন মানুষ পাটের বস্তা ছাড়া আর কিছু চিনত না, তখন ২০০২ সালে পাটকে ডাইভারসিফাইড করার জন্য জেডিপিসি প্রতিষ্ঠা করা হয়। এখন এই পাট দিয়ে আমরা ভ্যানিটি ব্যাগ, শাড়ি, ব্লেজার তৈরি করি।
হ্যাট, জুতা, ক্যাপ, ব্যাগ, কুশন কভার, ঝুড়ি, টব ঝোলানোর হ্যাঙ্গার, ল্যাম্প শেড, ফাইল অর্গানাইজার, পেপার বক্স, পেন হোল্ডার, কার্ড হোল্ডার, ম্যাগাজিন ও ফাইল বক্স, পেনসিল কেস, টি বক্স, টেবিল ক্লথ, কার্পেট, পর্দা, চেয়ারের কভার, ফ্লোর ম্যাট, টেবিল
রানার ইত্যাদি।
জেডিপিসির মাধ্যমে দেশে এখন ৮০০-এর বেশি উদ্যোক্তা তৈরি করা হয়েছে। হাতেকলমে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আমরা উদ্যোক্তা তৈরি করি। ১৫ দিনের প্রশিক্ষণ শেষে কাজ শিখে পণ্য বানান তাঁরা। তাঁদের জমা দেওয়া পণ্যগুলো বাজারজাত করার জন্য জেডিপিসিতে একটি ডিসপ্লে সেন্টার আছে।’ এ ছাড়া আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্য প্রচারণার জন্য বিভিন্ন দেশে মেলার আয়োজন করে জিডিপিসি।
পাট দিয়ে আরও কী কী পণ্য তৈরি করা যায় তা নিয়ে প্রতিনিয়তই গবেষণা চলছে। সামনে পরিবেশবান্ধব পণ্য হিসেবে পাটপণ্যের ব্যাপক ব্যবহার হবে বলে আশা করা যায়।
তথ্যসূত্র: ওয়ার্ল্ড জুট ডটকম, জেডিপিসি.জিওভি