লোকে তারে কয় মহানদী। হামরা তারে কই মহর্ষি, ব্রহ্মপুত্র। এবং আশ্চর্যের বিষয়, কুড়িগ্রাম থেকে সোজা ব্রহ্মপুত্রের চিলমারী বন্দরের দিকে গাড়ি হাঁকানোর সময় যে বিলটি পার হতে হয়, তার নাম নিধুয়া পাথার। সেই পাথারের এপার-ওপার দেখা যেত না একসময়। এখন তার বুক চিরে পিচের রাস্তা। সেই রাস্তায় চলে গাড়ি। সেই গাড়িতে বসে সোজা গিয়ে নামা যায় রমনা ঘাটে, যেখানে এখন মহানদী ব্রহ্মপুত্রের অধিষ্ঠান। সৈয়দ শামসুল হক যাকে বলেছেন ‘লৌহিত্য নদ’। ডেকেছেন ‘বাংলার জ্যেষ্ঠ সন্তান’ বলে। বলেছেন মহৎ, বলেছেন স্মৃতিধর, দয়াবান, প্রভাষক; আরও অনেক কিছু। আলোচকেরা তাকে বলেন ‘প্রাচীন বাংলার নদীপথের কেন্দ্রস্থল।’
এই যে এইখানে এসে এখন দাঁড়ায় মানুষ, যাকে ডাকা হয় রমনা ঘাট, সেখান থেকে ব্রহ্মপুত্রের অন্য পাড়ের দূরত্ব প্রায় পনেরো কিলোমিটার। পাহাড় ছেড়ে ব্রহ্মপুত্র যেখানে পলিমাটিতে পড়েছে, সেখানে তার প্রস্থ পঁচিশ থেকে ত্রিশ কিলোমিটার। এই বিশাল বপুর যে নদ, তাকে মহানদ ছাড়া অন্য কিছু বলা যায় কি? এই বিশাল নদীর বুকে সেই ষোলো শতকে মধু সাধুখাঁ বজরা নিয়ে ভেসে বেড়াতেন বাণিজ্যের আশায়। শুধু মধু সাধুখাঁই নন। বৃহৎ বঙ্গের প্রায় তামাম বাণিজ্য হতো ব্রহ্মপুত্রের বুকে জেগে থাকা চিলমারী বন্দর দিয়ে।
চিলমারী এখন কুড়িগ্রাম জেলার একটি উপজেলা মাত্র। আর ‘চিলমারী’ নামের সেই বিখ্যাত বন্দর এখন ব্রহ্মপুত্রের পশ্চিম তীর ছেড়ে ভাঙতে ভাঙতে চলে গেছে পূর্ব দিকে। প্রশাসনিক মাপকাঠিতে সেটি এখন একটি ইউনিয়ন মাত্র। মূলত চিলমারী সদর ইউনিয়ন আর অষ্টমীর চর, যা বারুণি স্নানের জন্য বিখ্যাত—এ দুটিই ছিল প্রাচীন চিলমারীর পশ্চিম প্রান্তের দুই সমৃদ্ধ জনপদ। ভাঙনের কারণে দুটি এলাকাই এখন ব্রহ্মপুত্রের পূর্ব দিকে চলে গেছে।
আমাদের জানা ইতিহাসমাত্রই মুঘল আমল থেকে। উজান কিংবা ভাটি, মুঘল আমলে যেখানেই যাওয়া হোক না কেন, যেতে হতো এই ব্রহ্মপুত্রের ওপর দিয়েই। আর তার প্রধান বন্দর ছিল চিলমারী। এখানে নৌযান থামত, বদল হতো দিক, যাত্রী উঠত কিংবা নামত। যদি নৌযান সোজাও চলত, চিলমারী ছিল অনিবার্য ‘বিরতিস্থল ও বাণিজ্যকেন্দ্র’। এখান থেকেই গন্তব্য নির্ধারিত হতো তিব্বত, ভুটান অথবা নেপালের পথে কিংবা বৃহৎ বঙ্গের বিস্তীর্ণ জনপদে। বাণিজ্য হতো কস্তুরি আর পোস্তদানার, যষ্টিমধু, এন্ডি সিল্ক আর ভোটকম্বলের। কখনো সন্তরা আর আমলকীরও। সন্তরা মানে কমলা। নেপাল বা আরও ওপরের দেশগুলো থেকে কমলা আসত চিলমারী দিয়েই। শুধু বাণিজ্যই নয়। নৌযুদ্ধেও চিলমারী ছিল প্রধানতম জলপথ। সে জন্যই সম্ভবত মুঘলদের জাহাজনির্মাণ শিল্প তৈরি হয়েছিল চিলমারীকে কেন্দ্র করে। সেই চিলমারীর বন্দর ঘন কুয়াশায় ঝাপসা এখন।
উপজেলা চিলমারীর আড়মোড়া ভাঙেনি তখনো। সকাল ৮টা। আমাদের জন্য অপেক্ষা করছেন রমনা খেয়াঘাটের মাঝি মমিনুল আর চর শাখাহাতি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক নাহিদ হাসান। ‘মনন রেখা’ নামের একটি ষাণ্মাসিক পত্রিকার সম্পাদক মিজানুর রহমান নাসিমসহ যখন রমনা ঘাটে পৌঁছলাম, তখন কুয়াশা কেটে গিয়ে অদ্ভুত এক ঝলমলে রোদ ব্রহ্মপুত্রের বুকে। সেই রোদে দেখা যায় রৌমারী ও রাজিবপুর থেকে দুটি খেয়া নৌকা এসে লেগেছে রমনা ঘাটে; আর দুটি ছেড়ে যাওয়ার জোগাড়যন্ত্র করছে। আমরা চলেছি চর শাখাহাতি।
টলটলে নীল জলের ওপর দিয়ে শ্যালো ইঞ্জিনচালিত নৌকা গিয়ে থামল চরের খেয়াঘাটে। নৌকা থেকে নেমে হাঁটা শুরু। একটুখানি এগোতেই দেখা হলো এবারের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে মেম্বার পদপ্রার্থী রফিকুল ইসলামের সঙ্গে। ষাটের কোঠায় বয়স তাঁর। নাহিদ হাসানের পরিচিত। মূলত পুরো চরটিই তাঁর পরিচিত। রফিুকল ইসলাম হাত দিয়ে দেখিয়ে দিলেন, ‘ওই যে ওই সরিষার খেত, ওইখানে আছিল রেল স্টেশন। এলা ভাঙি গেইছে।’ তাকিয়ে দেখলাম, নির্দিষ্ট জায়গাটিতে এখন হলুদ সরিষা মাঘের হাওয়ায় দুলছে। আমরা এগিয়ে গেলাম চর শাখাহাতির দিকে।
এখানে মানুষ গ্রাম সঙ্গে নিয়ে ঘোরে! শহরে থাকলে এসব জানা যায় না। তাই অবাক হতেই পারেন শুনে। নিজের ত্বক, দাঁত, চুলের মতোই এখানে নিজের অস্তিত্বের আরেক নাম গ্রাম। ফলে নদী গ্রাম ভাঙলে মানুষ নতুন বসতি তৈরি করে পুরোনো গ্রামের নামে। আমরা হাঁটতে থাকি। চারদিকে পলিজমা কৃষিজমি। সেই জমিতে জন্মে সুল্টি কলাই। মসুর ডালের মতো দেখতে মনে হলেও সেটা মসুর ডাল নয়। দেশের অন্য কোনো জায়গায় জন্মে না। এই অঞ্চলেই জন্মে। শুনলাম, সুল্টি কলাইয়ের ডাল বেশ সুস্বাদু।
হাঁটতে হাঁটতে সেই চরেরই আরেক প্রান্তে পৌঁছালাম আমরা চায়ের খোঁজে। সেই অংশের নাম বৈলমন্দিয়ার খাতা। পুরো চরে দু-তিনটি চায়ের দোকান; তার একটি এখানে। হাটবার বলে বন্ধ। ফিরে যাব, সে সময় ষাটোর্ধ্ব একজন কোত্থেকে উদয় হয়ে বললেন, ‘বসেন, দেখি কিছু পাই কি না।’ বলেই ডেকে আনলেন এক নারীকে। বোঝা গেল, তিনিই দোকানের মালকিন। চা নেই। অগত্যা চিনেবাদাম ভাজা আর পানি খাওয়া হলো। ষাটোর্ধ্ব সেই মানুষের নাম মো. মঞ্জু মিয়া। বয়স বললেন ৬৭। মঞ্জু মিয়া জানালেন, বয়সের কারণে এখন তিনি খেতে পারেন না খুব একটা। নইলে এক কেজি গাঞ্জিয়া চালের ভাত তাঁর কাছে কিছুই নয়। তবে তাঁরা গাঞ্জিয়া চালের ভাত খেতেন না, কিন্তু অনেক ধানের জাত হারিয়ে গেলে গাঞ্জিয়া ছাড়া উপায় নেই এখন। বেশ অনেকক্ষণ কথা হলো তাঁর সঙ্গে। তারপর উঠতে হলো। বেলা চড়ে যাচ্ছে।
এমন নিবিড় চরের ঘুঘুডাকা দুপুরে চোখে হেল্যুসিনেশন তৈরি হয়, রঙের। সবুজ খেত আর শীতের সোনালি রোদ একধরনের বিভ্রম তৈরি করে চোখে। সেই হেল্যুসিনেশনে দুলতে দুলতে পৌঁছালাম রোকেয়া খাতুনদের বাড়িতে। সেখানে দুপুরের খাবারের আয়োজন। গাঞ্জিয়া চালের ভাত, মাষকলাইয়ের ডাল, ঘাড়ভাঙা মাছের তরকারি বেগুন দিয়ে, বেগুনের পাট ভাজি আর খেসারির কচি পাতার ভাজি পেঁয়াজ-রসুন সাঁতলে। সঙ্গে প্রায় তিন শ মিলিলিটার মোষের দুধ। হ্যাঁ, এই চরে মোষেরা পাল বেঁধে ঘুরে বেড়ায় আর দুধ দেয়। জমি চাষের দায়িত্ব ট্রাক্টরের। ফলে মোষের দুধ আর দই এখানে পাওয়া যায় প্রচুর। তবে শীতকালে দই ঠিক জমে না বলে কেউ এখন দই পাতে না। দুপুর নামলে আমরা বেরিয়ে পড়ি ফিরতি পথের নৌকা ধরতে।
ব্রহ্মপুত্র বহি চলে নিরবধি। তার ওপর চর। তার ওপর বসে হাট। এই হাটের দুটি অংশ, নদীর তীরে একাংশ আর চরে একাংশ। চরের অংশের নাম জোরগাছ নামাহাট। দুই অংশই বসে রবি আর বুধবার। মোকছেদ আলীর মতো শত শত মানুষের গন্তব্য জোরগাছের নামাহাট। সপ্তাহের শুধু নয়, বহু প্রয়োজনীয় বিকিকিনি চলে সেইখানে। গরু, ঘোড়া, ছাগল, মাছ, চিনেবাদাম, সাবান-তেল-শ্যাম্পু, খাট-পালঙ্ক, ঘটিবাটি—সবকিছুর বিকিকিনি চলে সেখানে।
মোকছেদ আলীরা নেমে যান জোরগাছ হাটের চরের অংশে। আর আমরা চলি শহরের দিকে; শহুরে রুক্ষ ফুসফুসে ভরে ব্রহ্মপুত্রের তাজা বাতাস। কয়েক দিন তাজা রাখবে নিশ্চয়ই।
সূত্র: মননরেখা, চিলমারী সংখ্যা, সম্পাদক: মিজানুর রহমান নাসিম, ২০২১