সমুদ্রে ঘুরতে গিয়ে সেখান থেকে ছোট ছোট শামুক, ঝিনুকের খোলস নিয়ে আসেননি এমন মানুষ কমই আছেন। সেগুলো ব্যবহার করা হয় ঘর সাজানোর সামগ্রী হিসেবে। ইদানীং এই খোলসগুলো দিয়ে তৈরি হচ্ছে অলংকার। এগুলোর শুধু আর্থিক নয়, সামাজিক ও প্রাকৃতিক গুরুত্বও আছে অপরিসীম। তাই যখন জানতে পারলাম, এই সামুদ্রিক জিনিসগুলোকেই ভিন্ন ভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করা হচ্ছে প্রদর্শনীর মাধ্যমে, না গিয়ে পারিনি। প্রদর্শনীর শেষ দিনে হাজির হয়েছিলাম জাতীয় জাদুঘরের নলিনীকান্ত ভট্টশালী মিলনায়তনে। যেখানে গত ৩০ জুলাই শুরু হয়েছিল 'সমুদ্র শিল্পের খোঁজ' শীর্ষক একটি প্রদর্শনী।
মিলনায়তনে ঢুকতেই চোখে পরল সমুদ্রের দৃশ্য। তবে প্রদর্শনীর এক দিক থেকে দেখতে শুরু করাই ভালো বলে মনে হয় আমার। তাই ঢুকেই বাম দিক থেকে দেখা শুরু করলাম। প্রথম চিত্রটিতে চোখ আটকে গেল। একজন নারীর অবয়বে শামুক ঝিনুক দিয়ে তৈরি অসম্ভব সুন্দর অলংকার। গলায় শোভা পাচ্ছে বিভিন্ন ধরনের শামুকের খোলস, কানের দুলেও তাই। এর পরে বাঁধাই করা ছবিগুলোতে ম্যাচ বক্সের খোলসের ছবি আঁকা। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বুঝলাম, এগুলো বিভিন্ন ধরনের শামুক ও ঝিনুকের ছবি। সেগুলো মনসিজ আর্ট একাডেমির শিক্ষার্থীদের আঁকা। পাশাপাশি ১০টি ছবিতে ফুটে উঠেছে ১০ ধরনের শামুক ও ঝিনুকের তথ্য। এর পাশেই দেখানো হয়েছে কোন শামুকটি খাওয়া যায়, কোনটি দিয়ে অলংকার তৈরি হয় এই সব তথ্য।
ছবিগুলো দেখতে দেখতে খেয়াল হলো, কানে ভেসে আসছে সমুদ্রের তীরে আছড়ে পড়া ঢেউয়ের শব্দ। এ শব্দ ছবিগুলোকে আরও জীবন্ত করে তুলছে। এই সারিতে বেশির ভাগই অলংকারের ছবি যেগুলো আঁকা হয়েছে জলরং মাধ্যমে। তবে এই সারিতে ফাঁকা জায়গা জুড়ে দুটি শিল্পকর্মও স্থান পেয়েছে। মিশ্রমাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা প্রথম শিল্পকর্মটিতে বাঁশের কঞ্চি ও মেটালের কিছু থালা দিয়ে তৈরি করা হয়েছে অক্টোপাস। বালির ওপর ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে প্লাস্টিকের বোতল। আর একটি, এক জেলে কন্যার অবয়ব, ত্রিমাত্রিক সে শিল্পকর্মে প্রকৃতি ও মানুষের মেলবন্ধন ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। 'জলের কাব্য' নামের এই শিল্পকর্মটিতে শিল্পী মোহাম্মদ মাহমুদুল হাসান বলতে চেয়েছেন, জীববৈচিত্র্যকে বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করতে মানুষের ভূমিকা রাখার কথা। প্রকৃতি ও মানুষের একে অপরের ওপর নির্ভরশীলতার গল্পই যেন প্রতিটি ছবিতে বলার চেষ্টা করা হয়েছে ঘুরে ফিরে। দূষণ রোধ করার কথা বলা হয়েছে।
এই রঙের সমাহার ছেড়ে মুখোমুখি হই সমুদ্রের। মিলনায়তনে ঢুকতেই চোখে পরেছিল এই সমুদ্র। এ অংশটি বেশ বড় জায়গা জুড়ে রাখা হয়েছে। এখানে সমুদ্রের বিশালতা, তার সৌন্দর্য ও একে ঘিরে গড়ে ওঠা জীববৈচিত্র্য ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। এখান থেকে সরে কিছু দূর গেলে আরও বেশ কিছু চিত্রকর্ম চোখে পড়বে, সেগুলোর বিষয় সমুদ্র ও তার সম্পদ। বিভিন্ন দেশ ঝিনুক দিয়ে তৈরি বিভিন্ন দ্রব্যের বিশাল বাজার তৈরি করেছে বিশ্বময়। অথচ সামুদ্রিক সম্পদ ভিত্তিক জ্ঞান, কারুশিল্পে সামুদ্রিক সম্পদের যথাযথ ব্যবহার না জানা ইত্যাদি বিভিন্ন কারণে ঝিনুক শিল্প আমাদের দেশে বিকশিত হয়নি। কিছুটা দুঃখের সঙ্গে এ তথ্য জানালেন 'সমুদ্রে শিল্পের খোঁজ' নামে এ আয়োজনের আয়োজক এবং শিল্পী সাদিয়া শারমিন।
বর্তমান প্রজন্মকে সমুদ্রবিজ্ঞান বিষয়ক জ্ঞান, এর গুরুত্ব, ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা, পাশপাশি সচেতনতা ভিত্তিক কিছু বার্তা দিতেই ঢাকা ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তাঁদের শিল্পকর্ম নিয়ে এই প্রদর্শনীতে যুক্ত হয়েছিলেন। এ ছাড়া বিশেষ প্রদর্শনে শান্ত-মারিয়াম ইউনিভার্সিটি অব ক্রিয়েটিভ টেকনোলজির শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরাও যুক্ত ছিলেন। মনসিজ ক্র্যাফট আয়োজিত এ আয়জনের সহযোগিতা করেছে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের প্রাকৃতিক ইতিহাস বিভাগ, বাংলাদেশ ম্যাচবক্স কালেক্টরস ক্লাব, ফেরিত্রিল ও মনসিজ আর্ট একাডেমি।