আজকের পত্রিকা: দীর্ঘদিন ব্যাঙ্গালোর শহরে বসবাস করছেন। শহর হিসেবে ব্যাঙ্গালোর কেমন?
ফাতিমা জাহান: আমি যেসময় ব্যাঙ্গালোরে গিয়েছি সেসময়কার ব্যাঙ্গালোর আর এখনকার ব্যাঙ্গালোরের মাঝে ফাঁরাক অনেক। বিশ থেকে বাইশ বছর আগে ব্যাঙ্গালোরে বিদেশের আউটসোর্সিং কম্পানিগুলো সবে অফিস খুলতে শুরু করেছে। তখন জনসংখ্যাও তেমন ছিলো না, ছিলো না সুউচ্চ ভবন। সাধারণত সেখানে স্থানীয় মানুষজন বসবাস করতেন তখন। তবে পড়ালেখা করার জন্য ভারতের অন্যান্য রাজ্য এবং আশেপাশের দেশ থেকে প্রচুর ছাত্র আসতেন। তখন ব্যাঙ্গালোরের শিল্প সংস্কৃতিতে ছিল শুধুই দক্ষিণ ভারতীয় প্রভাব। আইনশৃঙ্খলা, নিয়মানুবর্তিতা, সময়ানুবর্তিতা, সততা তখনও ছিল, এখনও আছে। এ শহরে অন্যের ব্যক্তিগত বিষয়ে কেউ নাক গলায় না। সব ধর্মের মানুষ শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করে আসছে। এখনকার ব্যাঙ্গালোর আগের চেয়ে বিস্তৃত হয়েছে চারিদিকে। আগের মতো সেই ছিমছাম, ছায়াঘেরা, শান্ত, স্থানীয় শহরটি নেই। এখন উঁচু দালান বেড়েছে, বেড়েছে জনসংখ্যা, রাস্তায় গাড়ির সংখ্যা বেড়েছে। বিভিন্ন রাজ্য থেকে বিভিন্ন পেশায় কাজের আশায় আসা মানুষের সংখ্যা বাড়ার কারণে এখন ব্যাঙ্গালোরকে ঠিক আর আগের মতো দক্ষিণী সংস্কৃতির শহর বলা যায় না। একটা বহুজাতিক সংস্কৃতির শহর হয়ে গিয়েছে এটি।
আজকের পত্রিকা: বসবাস করছেন ব্যাঙ্গালোর শহরে। কিন্তু লিখলেন ‘লখনউনামা’। কারণ কী?
ফাতিমা জাহান: আমি ব্যাঙ্গালোরে অস্থায়ীভাবে বহুবছর ধরে বসবাস করলেও মনে প্রাণে একজন বাঙালি। দক্ষিণ ভারতের ভাষা, সংস্কৃতির সঙ্গে বাংলাদেশের ভাষা, সংস্কৃতির খুব একটা মিল নেই। বাংলাদেশের সংস্কৃতি, ভাষা, সাহিত্যে কয়েক শ বছর ধরে প্রভাব বিস্তার করে চলেছে উত্তর ভারতের ভাষা ও সংস্কৃতি। এক সময় ভারত উপমহাদেশের দরবারি ভাষা ছিল ফারসি। পারস্য থেকে আসা লখনউয়ের নবাবগণ সঙ্গে করে কবিতা, গজল, আদবকায়দা, পোশাক পরার ধরন, খাদ্য ইত্যাদি শুধু নিয়েই আসেননি, এ উপমহাদেশে জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন। খোদ বাংলা ভাষায় আট হাজারের বেশি ফারসি শব্দ আছে। বিরিয়ানি, কাবাব থেকে শুরু করে ঘুরি ওড়ানো, পশুপাখির লড়াইয়ের মতো সৌখিন খেলাধুলা বাংলায় পরিচিত করেছেন লখনউয়ের নবাবগণ। আমাদের এক জেনারেশন আগের মানুষজনও কিন্তু ফারসি পড়তে-লিখতে পারতেন। সকালে ঘুম থেকে উঠে রাতে ঘুমানো পর্যন্ত আমরা বহুভাবে লখনউয়ের রীতিনীতি পালন করি।
আমি বিজ্ঞানের ছাত্র হলেও ইতিহাস আমার প্রিয় বিষয়। নিজেদের সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িয়ে থাকা ইতিহাস জানবার জন্যই আমি বারবার লখনউ গিয়ে খোঁজ করেছি সেই ইতিহাস।
ফাতিমা জাহান: আমার লেখা প্রথম বই ছিল কবিতার। ইংরেজি মাধ্যমে পড়ার কারণে এবং বাংলা ভাষা চর্চা থেকে দূরে থাকার কারণে আমি বাংলায় তেমন পরিণত ছিলাম না। ৬/৭ বছর আগে নিজ উদ্যোগে বাংলা শেখা ও লেখা শুরু করি। তখন ছোট ছোট কবিতা লিখে বাংলার চর্চা শুরু হয়েছিল। এরপর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আমার ভ্রমণের ছবি দেখে বিভিন্ন পত্রিকার সম্পাদকগণ আমার কাছে ভ্রমণ কাহিনি চাওয়া শুরু করেন। সাহস করে দুই একটা লিখে ফেলার পর আরও অনুরোধ আসতে থাকে। এভাবেই তৈরি হয়ে যায় আমার প্রথম ভ্রমণগ্রন্থ ‘মওলানা জালালউদ্দিন রুমির খোঁজে তুরস্কে’। তবে লেখক হিসেবে আমি খুবই অলস এবং বাংলা শিক্ষার্থী হিসেবে এখনও নবীন। সম্পাদক-প্রকাশকের তাড়া না থাকলে হয়তোবা দ্বিতীয় ভ্রমণগ্রন্থ ‘লখনউনামা’ গুছিয়ে মলাটবন্দী করতে পারতাম না।
আজকের পত্রিকা: আপনার ভ্রমণ অভিজ্ঞতার তুলনায় বইয়ের সংখ্যা বেশ কম। কারণ কী?
ফাতিমা জাহান: বই প্রকাশের ইচ্ছা আমি কখনোই নিজ থেকে পোষণ করি না। আমি ভ্রমণ করি নিজের জন্য। ভ্রমণ আমার কাছে এক ধরনের প্রার্থনা। আমি ভ্রমণেই মগ্ন থাকি। অন্যান্যদের মতো আমি খুব সামাজিক নই। অন্যদের মতো আমারও বই প্রকাশ করতে হবে, এমন তাড়া আমি নিজ থেকে কখনোই অনুভব করি না। আরেকটি বিষয় হলো, লেখক হিসেবে আমি ভীষণ খুঁতখুঁতে। একটি বই মানে একটি ডকুমেন্ট। রিল, টিকটক, ইউটিউব এসবই ক্ষণস্থায়ী আনন্দদায়ক মাধ্যম। কিন্তু একটি বই সেভাবে লেখা হলে হাজার বছর পরেও কারো উপকারে আসতে পারে। বই লেখা সাধনার ব্যাপার। আমার ধারণা, আমি এখনও সেই সাধনার স্তরে পৌঁছাতে পারিনি।
আজকের পত্রিকা: ভ্রমণ আপনার প্রিয় বিষয়। সম্ভবত উত্তর ও দক্ষিণ মেরু বাদে আপনি সব মহাদেশের কোনো না কোনো দেশে গেছেন। ভ্রমণে উৎসাহিত হওয়ার কারণ কী?
ফাতিমা জাহান: ভ্রমণ আমার কাছে প্রার্থনার মতো। প্রার্থনায় মানুষ মনে শান্তি পায়। আমি পাই ভ্রমণে। এ ছাড়া নিজের দেশ, জাতি, সংস্কৃতির বাইরে এই বিশাল পৃথিবীতে কত কিছু যে জানার আছে, শেখার আছে, তা ভ্রমণ ছাড়া সম্ভব নয়। এমনও হয়েছে, কোনো একটি জায়গা সম্পর্কে আমি কিছু না জেনে চলে গিয়েছি আর ফিরে এসেছি ঝুলি ভর্তী জ্ঞান ও আনন্দ নিয়ে। এই অভিজ্ঞতাই হয়তো ভ্রমণে আমাকে আরও বেশি উৎসাহিত করেছে।
ফাতিমা জাহান: সোলো ট্রাভেলার হওয়ার পেছনে প্রধান কারণ, আমি আমার ভ্রমণের সময় ও সুযোগ মতো খুব কম সঙ্গী পেয়েছি যার রুচি আমার সঙ্গে মেলে। আরও একটি কারণ, যেকোনো জনপদে আমি দীর্ঘ সময় নিয়ে ভ্রমণ করি। সেখানকার ভাষা, সংস্কৃতি সম্পর্কে জানি। দীর্ঘ সময় নিয়ে ভ্রমণ করা যায়, ভারত উপমহাদেশে এখনও এই কনসেপ্টটি ঠিক মতো দানাবাঁধেনি। ভারতবর্ষের মানুষ এখনও ভিনদেশী সংস্কৃতি বা খাবারে রপ্ত হতে পারেনি। সব জায়গায় নিজেদের পছন্দ মতো খাবার বা আবাস পাওয়া যে যাবে, এমনও নয়। আমি বেশ কয়েক বছর মাউন্টেইন ক্লাইম্বিং করেছি। তাই থাকা খাওয়া নিয়ে আমার বায়াসনেস নেই। অনেক সময় প্রত্যন্ত অঞ্চলে ভ্রমণের সময় নাগরিক সুযোগ সুবিধা একেবারেই মেলে না। এটিও শহুরে ভ্রামণিকদের ভ্রমণে নিরুৎসাহিত করে। যত প্রতিকূলতা থাকুক না কেন, আমি তাই সঙ্গী না পেলে একাই বেরিয়ে পড়ি।
এমনও হয়, কোনো একটা জায়গা আমার পছন্দ হলো কিন্তু আমার সঙ্গীর হলো না বা ভাইসভার্সা। তখন ভ্রমণের আনন্দ মাটি হয়ে যায়।
ফাতিমা জাহান: ভ্রমণে গিয়ে আমি বিপদের মুখোমুখি হইনি। তবে বিপদ হতে পারে এমন জায়গায় ভ্রমণ করেছি। একবার কাশ্মীরে কারফিউ চলাকালীন সময়ে গিয়ে হাজির হয়েছিলাম। ভীষণ ঝুঁকিপূর্ণ ছিল সে যাত্রা। অ্যাডভেঞ্চার আমার রক্তে মিশে আছে। এটা এক ধরনের নেশা। রাজ্য জয় করার নেশার মতো।
আজকের পত্রিকা: ব্যাঙ্গালোরসহ দক্ষিণ ভারতের অনেক শহর এখন বাঙালিদের প্রিয় গন্তব্য হয়ে উঠেছে। বিষয়টিকে কীভাবে দেখেন।
ফাতিমা জাহান: এই বিষয়টিকে আমি খুব ইতিবাচক ভাবে দেখি। বেশির ভাগ বাঙ্গালীকে অনেকেই বলেন কুয়োর ব্যাঙ। বাঙ্গালী যে উত্তর দক্ষিণে ভ্রমণের উদ্দেশ্য ছড়িয়ে পড়ছে, ব্যাপারটি খুবই আশাবাদী করে আমাকে। দক্ষিণ ভারতের ভাষা ভিন্ন, ভিন্ন এদের খাবার ও সংস্কৃতি। মানুষ যত ভ্রমণ করবে, তত জানবে, ততই অন্য জাতিকে শ্রদ্ধা করতে শিখবে।
ফাতিমা জাহান: সততা, দায়িত্বশীলতা, সময়ানুবর্তিতা ও নিয়মানুবর্তিতার জন্য দক্ষিণ ভারত নিজের জায়গা অনেক আগেই করে নিয়েছে। দক্ষিণ ভারতের সেবা খাত অভূতপূর্ব উদাহরণ হয়ে থাকতে পারে বাংলাদেশের জন্য। চিকিৎসাবিজ্ঞানে রোবোটিক টেকনোলজির ব্যবহার এক যুগের বেশি সময় আগে থেকে হয়ে আসছে, যার প্রয়োগ আমি দেশে হয় বলে এখনও শুনিনি। উন্নত দেশে যখন যে প্রযুক্তির ব্যবহার চালু হয় ভারতে তা সঙ্গে সঙ্গে চলে আসে, বিশেষ করে ব্যাঙ্গালোরে। এ বিষয়ের সঙ্গে চিকিৎসা সেবায় জড়িত সকলকে প্রশিক্ষণও দেওয়া হয়।
একজন চিকিৎসক যে পরিমাণ সময় নেন একজন রোগী দেখতে বা কেইস হিস্ট্রি নিতে, তার নজির আমাদের দেশে খুব কম। এ ছাড়া সেখানকার যোগাযোগব্যবস্থা বহুলাংশে ভালো, জিনিসপত্রের দাম তুলনামূলকভাবে কম, নিরাপদ নগর হওয়ার কারণে চুরি ছিনতাইয়ের ভয় নেই, নারীদের চলাফেরা বা পোশাকে নেই কোনো আরোপ। অকারণে হয়রানিমূলক আচরণের আশঙ্কা নেই। কাজ করে দেবার নাম করে টাকাপয়সা মেরে দিয়ে উধাও হয়ে যাবার উদাহরণও খুব বেশি পাওয়া যায় না। ব্যাঙ্গালোরের পুলিশ ও প্রশাসন এ ব্যাপারে শক্ত অবস্থানে আছে।
আজকের পত্রিকা: দেশের যে নারীরা সলো ট্রাভেল করতে চায় তাদের জন্য কী বলবেন?
ফাতিমা জাহান: নিজেকে জানার জন্য, নিজের মনের চাহিদা বোঝার জন্য, নিজের ব্যক্তিত্বকে উপলব্ধি করার জন্য প্রত্যেক মানুষের সোলো ট্রাভেলিং করা উচিৎ বলে আমি মনে করি। বেশিরভাগ মানুষ সমাজ যেভাবে শিখিয়ে দেয় সেভাবে পরিচালিত হয়, কিছুটা বাধ্য হয়ে কিছুটা নিজের বিবেক বুদ্ধি ব্যবহার না করে। আমাদের দেশের নারীরা সব ক্ষেত্রে অনেক পিছিয়ে আছে। নারীদের অগ্রযাত্রাকে আমি সবসময়ই উৎসাহিত করি। বহু দেশে নারীর কাজ বা পুরুষের কাজ বলে আলাদা কিছু নেই।
যারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে সোলো ট্রাভেলিং করতে চান তাঁদের বলব, আর দেরি নয় বেরিয়ে পড়ুন। জগৎ বিশাল কিন্তু জীবন ছোট। এক জীবনে অনেক কিছু করার আছে, জানার আছে, শেখার আছে। আর এই সাহস, এই শিক্ষা ছড়িয়ে দিন সবার মাঝে। ভ্রমণ মানুষের হৃদয়ের পথ প্রশস্ত করে, একজন মানুষকে আলোকিত করে। এই আলোর মাঝেই যেন আমাদের বসবাস হয়।