সেই কোন ছেলেবেলায় পঞ্চম শ্রেণিতে পড়েছি, পৃথিবীর ছাদ পামির মালভূমি। সেই মালভূমির পথ ধরে হাঁটব, কখনো ভাবিনি।
উজবেকিস্তান ভ্রমণের পর গিয়েছি মধ্য এশিয়ার তাজিকিস্তানে। দেশটির ৯০ ভাগ অঞ্চল পাহাড়ে ঘেরা। আর ৪৫ ভাগ জুড়ে রয়েছে পামির অঞ্চল। এ দেশের পামির অঞ্চলের নাম গর্নো-বাদাখশান প্রদেশ।
প্রথম গন্তব্য কালাইখুম্ব, দুসানবে থেকে ৩৮৫ কিলোমিটার দূরে। গর্নো-বাদাখশান প্রদেশের প্রথম জেলা দারভোজ পামির হাইওয়ের প্রবেশদ্বার। কালাইখুম্ব হলো সেন্টার অব দারভোজ—এ রকমই বলেছেন আমার পামির গাইড ও ড্রাইভার হুসেন। আজ রাত যাপন করা হবে কালাইখুম্ব শহরে। পথ খুব মায়াভরা।
পথের চারধারের সুউচ্চ পর্বতমালা দেখে আমি যতবার জানতে চেয়েছি, হুসেন, আমরা কি পামির হাইওয়েতে প্রবেশ করেছি? হুসেন ততবারই অট্টহাসিতে ফেটে পড়ছেন। দুসানবে থেকে ২২০ কিলোমিটার যাওয়ার যাবে এল পামির অঞ্চল।
চলতে চলতে হুসেনের গাড়ি থামল একটি নীল বোর্ডের কাছে। আমার হাতের ডান পাশে আফগানিস্তান! মাঝে কেবল পাঞ্জদরিয়া নদী। ওই তো আফগান পাহাড়! মনে হচ্ছে পাঞ্জদরিয়া সাঁতরে পার হয়ে ওপাশে চলে যাই।
বোর্ডের পাশে দাঁড়িয়ে দূরে একটি ব্রিজ দেখতে পাচ্ছি। হুসেন পরিচয় করিয়ে দিলেন, এটি হচ্ছে তাজিক-আফগান ব্রিজ। পামির হাইওয়েতে চলতে এ রকম পাঁচটি সেতু দেখা যায়। প্রতি শনিবার এই সেতুতে বাজার বসে দুই দেশের বিক্রেতাদের। সে সময় অনায়াসে আফগান ভূখণ্ডে পা রাখা যায়। খুব ইচ্ছা ছিল বাজারটি দেখার, কিন্তু সময় মেলেনি। পাঞ্জদরিয়ার এপাশে তাজিক বাদাখশান প্রদেশ, ওপাশে আফগান বাদাখশান প্রদেশ। উনিশ শতকের আগপর্যন্ত পুরোটাই ছিল বাদাখশান প্রদেশ এবং পামির হাইওয়ে। প্রতিটি ব্রিজের পাশে মিলিটারি ক্যাম্প।
শেষ বিকেলে উপস্থিত হলাম কালাইখুম্ব শহরে। ছোট ছিমছাম পাহাড়ি সড়কের শহর। শহরের মাঝ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে পাঞ্জদরিয়ার ছোট একটি শাখা। স্রোতস্বিনী একেবারে!
ভোররাত তিনটা। পুরো শহর বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। আমি আর হুসেন কেবল জেগে রয়েছি। পরের পথ গরমচশমা পর্যন্ত। ঘুটঘুটে অন্ধকার পথ। জিপের হেডলাইটের আলো দিয়েও দেখা যাচ্ছে না। তার ওপর পথ এবড়োখেবড়ো। জিপের সিটে ভালো করে বসাও যাচ্ছে না।
হুসেন বলছেন, এ রকম পথ রয়েছে বেশ খানিকটা। এখন রাত সাড়ে তিনটা; সকাল ৮টা পর্যন্ত এ রকম চলতে হবে। ভোররাতে রওনা হওয়ার কারণ হলো, পামির হাইওয়ে সংস্কারের কাজ চলছে। পথ ব্লক হয়ে নাকি ৫-৬ ঘণ্টার একটি যাত্রাবিরতি হয়। শ্রমিকেরা কাজ শুরুর আগেই যাতে কিছু জায়গা পার হওয়া যায়, তার জন্য ভোররাতে যাত্রা। আজকের গন্তব্য প্রায় ৪০০ কিলোমিটার। তবে পথ সংস্কার করলে পামিরের ডেডলি হাইওয়ে বিষয়টি আর উপভোগ্য থাকবে না।
গাড়ি চলছে। আমি আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে থাকি দূরের আফগান পথে। মাঝে গমের খেত, পাথরের বাড়ি, ধূসর পাহাড়ের মধ্যে আচমকা একখণ্ড সবুজ চোখে পড়ে। আমার আগ্রহ দেখে হুসেন জিপ থামিয়ে একটি আফগান স্কুল দেখালেন। আমি বেশ খানিকক্ষণ তাকিয়ে থাকলাম। দূর থেকে মনে হচ্ছে, আফগান আর তাজিক পাহাড় সড়কের এক বিন্দুতে মিলেছে। কিন্তু কাছে গেলেই দুই
ভূখণ্ড আলাদা।
পামিরের পথে রাত যাপন করেছি কালাইখুম্ব ও গরমচশমা শহরে। যাত্রাপথে ঘুরেছি কালোট, খড়্গ, ভারাম এবং ইসকাশিম শহর। ছুঁয়ে গেছি কত নাম না জানা গ্রাম আর এলাকা। তাজিক পামির অঞ্চল যেমন দেখেছি, একই রকম উপভোগ করেছি আফগান পামির অঞ্চল। কিন্তু আমার চোখ আর ক্যামেরা বেশির ভাগ সময় তাক করা থাকত আফগান গ্রামগুলোর দিকে। মনের অজান্তে নিজেকে বলছি, ‘এলিজা, তুমি তাজিক পামির উপভোগ করতে এসেছ।’