অ্যাডভেঞ্চারপ্রেমীদের জন্য নেপাল উপযুক্ত জায়গা। উঁচু পাহাড়ে ট্রেকিং থেকে শুরু করে প্যারাগ্লাইডিং কিংবা বাঞ্জি জাম্পিংয়ের মতো দুর্দান্ত সব কর্মকাণ্ডের জন্য এক নামে পরিচিত দেশটি। তবে এসব অ্যাকটিভিটি ছাড়াও সব ধরনের ভ্রমণপিয়াসির জন্য নেপালে কিছু না কিছু কর্মকাণ্ড রয়েছে।
কাঠমান্ডুর থার্টি ফার্স্ট নাইট, মাইনাস ৮ ডিগ্রি তাপমাত্রার কালিং চক, কেব্ল কারে পাহাড়চূড়ায় উঠে হিমালয় দেখে কেটে গেল দুটি দিন। এরপর নাগরকোট। সেখান থেকে কাঠমান্ডুর থামেল। চতুর্থ দিন দীর্ঘ গাড়িযাত্রায় ক্লান্ত হয়ে পোখারা পৌঁছাই।
দোতাং পাহাড়ের বুকে বয়ে চলা ফেওয়া লেকে মাছের নাচানাচি আর ওপারে বইছে অন্নপূর্ণার শীতল হাওয়া। তারই মাঝে ১ হাজার ৭০০ মিটার উঁচু সারাংকোট পাহাড় থেকে ঝাঁপিয়ে পড়তে যাচ্ছি আমি! ভাবতেই শিহরণ খেলে যায় শরীরে।
পোখারায় প্রথম রাতেই স্থানীয় একটি এজেন্সির সঙ্গে কথা বলে রেখেছিলাম সকালে প্যারাগ্লাইডিং ও বাঞ্জি জাম্প করার জন্য। এখানে বলে রাখা ভালো, এসব করার জন্য এজেন্সিগুলোর সঙ্গে চুক্তি করে নিতে হয়। তাতে প্যারাগ্লাইডিং ও বাঞ্জি জাম্পের সময় ভিডিও এবং ছবি তুলবেন কি না, সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে হয়। এ জন্য অতিরিক্ত অর্থ দিতে হবে। প্যারাগ্লাইডিংয়ের জন্য ৮ হাজার নেপালি রুপি এবং বাঞ্জি জাম্পিংয়ের জন্য ৬ হাজার ৫০০ নেপালি রুপি ব্যয় করতে হয়েছে।
নেপালে প্যারাগ্লাইডিং ও বাঞ্জি জাম্পিং করার জন্য বেশ কিছু পয়েন্ট আছে। সকাল ১০টায় হোটেলের সামনে চলে এল গাড়ি। চট করে গাড়িতে উঠে একাই রওনা হলাম সারাংকোট পাহাড়চূড়ার দিকে। গাড়িতে উঠে পরিচয় হলো একজন নেপালি, অস্ট্রেলিয়ান এবং দুজন ইতালিয়ানের সঙ্গে। তাঁরাও আমার মতো আকাশে উড়বেন।
পথে গাড়ি থামানো হলো এজেন্সির অফিসে। সেখানে সবার চুক্তি স্বাক্ষর সেরে নিলাম এবং পাইলটদের নিয়ে মোট এক ঘণ্টার ভ্রমণ শেষে সোজা সারাংকোট পাহাড়ের চূড়ায়। একে একে সবাই পাইলটকে সঙ্গে নিয়ে আকাশে উড়াল দিল, আমি উড়লাম সবার শেষে।
পাইলটের ওপর বিশ্বাস রেখে উড়াল দিলাম আকাশে! নিজেকে পাখির মতো মনে হচ্ছিল। কী নেই এখানে? বরফ পাহাড় আর ফেওয়া লেকের সৌন্দর্য—পাখির চোখে সবকিছুই দারুণ লাগছিল। ছবি আর ভিডিও করার সময় হলো। প্রায় ১০ মিনিট ওড়ার পর পাইলট অ্যাক্রোবেট করার অফার করলেন। প্যারাগ্লাইডিংয়ের কসরত হলো অ্যাক্রোবেট। তিনি আপনাকে নিয়ে বিভিন্ন অ্যাঙ্গেলে দ্রুততার সঙ্গে উঁচু-নিচু আর এদিক-সেদিক সাঁই সাঁই করে নানান কসরত করবেন। আমি বিষয়টির সঙ্গে পরিচিত ছিলাম বলে রাজি হলাম। অ্যাক্রোবেটিকের জন্য অতিরিক্ত অর্থ দিতে হবে এবং সেটার পুরোটা পাবেন পাইলট। আমি ১ হাজার ৫০০ নেপালি রুপিতে আকাশে উড়তে উড়তেই চুক্তি করলাম।
ল্যান্ডিং শেষে আমরা ছবি তুললাম পাইলটদের সঙ্গে। সব মিলিয়ে ১৫-২০ মিনিট উড়ে বেড়িয়েছি আকাশে।
বাঞ্জি জাম্পিংয়ের জন্য পরবর্তী গন্তব্যে পৌঁছাতে প্রায় ২টা বেজে গেল। নেপালে বাঞ্জি করার অনেকগুলো জায়গা আছে। আমি বেছে নিয়েছিলাম হাই গ্রাউন্ড অ্যাডভেঞ্চার। এখানে ৭৫ মিটার উঁচু টাওয়ার থেকে বাঞ্জি জাম্প করা যায়। গাড়ি এসে গেলে দুপুরে না খেয়েই ৩০ মিনিটের পথ পাড়ি দিয়ে চলে গেলাম বাঞ্জি জাম্পিংয়ের জায়গায়। ওই সময় আমি একাই ছিলাম সেখানে। বাঞ্জি জাম্প করার জন্য নানান তথ্য দিয়ে নিবন্ধন শেষে সম্মতিপত্রে সই করতে হয়। এরপর একটি লকার ও টি-শার্ট দেওয়া হয়। ঘড়ি, মুঠোফোন, মানিব্যাগসহ পকেটের সবকিছু রাখার জন্য লকার।
পরে আমাকে নিয়ে যাওয়া হলো টাওয়ারের ওপরে। টাওয়ারটির নিচে একটু পাশে কয়েক শ মিটারের খাদ, দেখেই ভয় লাগে। আগেই শরীরের সঙ্গে সিকিউরিটির যে কভারটি পরানো হয়েছিল, তার সঙ্গে কয়েকটি বাকল এবং বাঁহাতে একটি অ্যাকশন ক্যামেরা ধরিয়ে দেওয়া হলো। এরপর প্রশিক্ষণের পালা। শেষে একদম সামনে নিয়ে গিয়ে ক্যামেরায় নিজের অনুভূতি বর্ণনা করলাম।
পাখির ডানার মতো দুই হাত দুই পাশে রেখে আমাকে পেছন থেকে ছেড়ে দেওয়া হলো শূন্যে। পুরো উত্তেজনা নিয়ে লাফ দিলাম। নিচে তাকিয়ে দেখি, পৃথিবী পুরোই গোল! চোখে সর্ষের ফুল দেখছি। ৫ থেকে ৬ সেকেন্ড একটু ভয় লাগলেও পরে নিজেকে মানিয়ে নিলাম। হাতে লাগানো অ্যাকশন ক্যামেরায় নানান পোজ দিতে দিতে নিচের দিকে পতন অনুভব করছি।
এই অভিজ্ঞতা ভাষায় বোঝানো যাবে না। পায়ের দড়িতে টান খেয়ে থেমে গেলাম। কিছুক্ষণ ঝুলে রইলাম। দেখলাম নিচে বোট নিয়ে অপেক্ষা করছে এক ব্যক্তি। তিনি আমাকে পায়ের সঙ্গের দড়ি টানতে বললেন। কিছুক্ষণ টানার পর বোটে নেমে এলাম। পরে পাহাড় বেয়ে উঠে গেলাম অফিসে ছবি দেখার জন্য। দুটি ক্যামেরা দিয়ে পুরো সময়টির ছবি তোলা ও ভিডিও করা হয়। ওরা সাধারণত মেইলে পাঠিয়ে দেয়। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেওয়ার পরে আমাকে ওদের গাড়িতে করে পোখারায় পৌঁছে দেওয়া হলো।
এরপর সবাই চলে গেলাম ফেওয়া লেকে। ওখানে ঘণ্টাখানেক কায়াকিং করে হোটেল রুমে ফিরে এলাম।