হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব আজিজুল হক ইসলামাবাদী গতকাল শুক্রবার বলেছেন, হেফাজত হিন্দু সম্প্রদায় কিংবা ইসকনের বিপক্ষে নয়। তিনি বলেন, ‘ইসকন সদস্যরা একটি ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে চট্টগ্রামে মুসলিম দোকানদারের ওপর হামলা চালিয়েছেন। এই ষড়যন্ত্র করেছে আওয়ামী লীগ এবং উদ্দেশ্য ছিল ধর্মীয় সম্প্রীতি নষ্ট করা।’
ভারতীয় সংবাদ সংস্থা এএনআইকে দেওয়া বিশেষ সাক্ষাৎকারে আজিজুল হক ইসলামাবাদী বলেছেন, ‘ইসকনের বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয়ভাবে কোনো কর্মসূচি দেয়নি হেফাজতে ইসলাম, বরং মুসলিমদের উত্তেজিত হওয়া থেকে বিরত রাখতে এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হেফাজত দায়িত্ব নিয়েছে।’
আজিজুল হক আরও বলেন, ‘মুসলিম দোকানদারকে নির্দয়ভাবে মারধর করা হয়েছে, তাঁর দোকান ভাঙচুর করা হয়েছে। মুসলিমদের উসকে দিতে বিভিন্ন উসকানিমূলক স্লোগান দেওয়া হয়েছে। এতে বড় ধরনের সাম্প্রদায়িক সংঘাতের ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।’ হেফাজতের এই নেতা আরও বলেন, ‘ইসকন নিষিদ্ধের কোনো দাবি আমরা করিনি। মিডিয়ায় প্রকাশিত খবর ভুল। আমরা প্রকৃত অপরাধীদের শাস্তির দাবি জানিয়েছি।’
গত ৫ নভেম্বর চট্টগ্রামের ওসমান আলী নামে এক দোকানদার ফেসবুকে ইসকনের সমালোচনা করে একটি পোস্ট দেন। এতে ইসকন নিষিদ্ধের দাবিও জানানো হয়। এর পরপরই সংঘর্ষ বাধে হিন্দু সম্প্রদায় ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মধ্যে। যৌথ বাহিনী সেখানে অভিযান চালিয়ে প্রায় ৮০ জনকে গ্রেপ্তার করে। ইসকন তাদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ অস্বীকার করে। সংগঠনটি বলেছে, ‘চট্টগ্রামের হাজারি গলি এলাকায় সংঘটিত হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা নিয়ে ভুল তথ্য ছড়ানো হচ্ছে।’
আজিজুল হক ইসলামাবাদী বলেন, “হেফাজতে ইসলাম একটি বড় আকারের অরাজনৈতিক ধর্মীয় সংগঠন। হেফাজতের দায়িত্ব হলো বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিকের ধর্মীয় অধিকার ও মূল্যবোধ রক্ষা করা। পাশাপাশি, দেশের জনগণকে, বিশেষ করে মুসলিম সম্প্রদায়কে সভ্যতা, সংস্কৃতি ও নৈতিকতা অনুসরণ করে আধ্যাত্মিক চর্চার প্রতি আগ্রহী করে তোলা। হেফাজতে ইসলাম অরাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে শুধু মুসলিমদের নয়, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান, চাকমা, মারমা—সবার অধিকার দাবি করে।’
হেফাজতের এই নেতা আরও বলেন, ‘গত ১৫০ বছর ধরে ঐতিহ্যবাহী হাটহাজারী দারুল উলুম মাদ্রাসার পাশেই পাঁচ ইঞ্চি দেয়ালের ওপারে রয়েছে একটি হিন্দু মন্দির। এমন সম্প্রীতি, সহাবস্থান পৃথিবীর আর কোথাও আছে বলে আমরা জানি না। হেফাজতে ইসলামের নেতা–কর্মীরা সব সময়ই হিন্দুদের ধর্মীয় স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করে আসছেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘গত জুলাই বিপ্লবের সময়ও আমাদের নেতা-কর্মীরা হিন্দু ভাইদের মন্দির ও ঘরবাড়ি পাহারা দিয়েছেন। আমরা সহাবস্থানে বিশ্বাস করি। আমরা সবার ধর্মীয় স্বাধীনতায় বিশ্বাস করি। সহাবস্থানের মাধ্যমে বিশ্বে একটি উদাহরণ সৃষ্টি করতে চাই।’
ভারত প্রসঙ্গে হেফাজতের এই নেতা বলেন, তাদের সংগঠনের নেতাদের ভারতের জনগণের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক রয়েছে। কিন্তু তারা অবাক হয়েছেন যে, ভারত সরকার শেখ হাসিনার উৎখাত হওয়া সরকারের অপকর্মে সাহায্য করছে। এ জন্যই তারা ভারতকে সমালোচনা করেছেন।
তিনি বলেন, ‘হেফাজতে ইসলামের মূল কেন্দ্র ভারতর দারুল উলুম দেওবন্দ। হেফাজতের অধিকাংশ আলেমই দারুল উলুম দেওবন্দ থেকে পাস করা। ভারতের সঙ্গে আমাদের নাড়ির সম্পর্ক। কিন্তু বর্তমানে ভারতের সরকার আমাদের দেশের পতিত ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারকে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছে। ভারতের সহযোগিতার কারণে আওয়ামী লীগ সরকার বাংলাদেশে অত্যাচার, নির্যাতন এবং নিপীড়ন চালানোর সাহস পেয়েছে। এ কারণেই আমরা ভারত সরকারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে বিবৃতি দিয়েছি। যদি ভারত বাংলাদেশি জনগণকে বন্ধু হিসেবে মনে করে, তাহলে ভারত সরকারের উচিত এই দেশের মানুষের চাহিদা বোঝা। যদি সেরকম বন্ধুত্ব স্থাপন করা যায়, তাহলে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের মধ্যে কোনো উত্তেজনা থাকবে না।’
সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার প্রসঙ্গে আজিজুল হক বলেন, ‘বাংলাদেশে হিন্দু বা সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণ কখনোই দেশের ইসলামি আলেম সমাজ বা ধর্মীয় ব্যক্তিত্বরা করেনি। সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণ ছিল রাজনৈতিক উদ্দেশ্য বা রাজনৈতিক সংঘাতের কারণে, অথবা কোনো লক্ষ্য অর্জনের জন্য। আমি চ্যালেঞ্জ করে বলতে পারি, কেউ প্রমাণ করতে পারবে না যে কোনো ইসলামি আলেম, ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব বা মাদ্রাসা হিন্দুদের কোনো জমি দখল করেছে। পূর্ববর্তী ফ্যাসিবাদী সরকারের লোকেরা, যাদের হিন্দুরা বিশ্বাসযোগ্য মনে করত তারাই অধিকাংশ হিন্দুর জমি দখল করেছে। তাদের বাড়ি দখল হচ্ছে। হিন্দুদের দেশ থেকে পালিয়ে যেতে বাধ্য করা হয়েছে তাদের জমি দখল করার কারণে।’
তিনি আরও বলেন, ‘ইসলাম শান্তির ধর্ম। ইসলামের বার্তা হলো—শান্তি, নিরাপত্তা এবং মানুষের জন্য সমান অধিকার। ইসলাম ন্যায়ের মূলনীতি অনুসরণ করে। সংখ্যালঘু ও অন্যান্য ধর্মের প্রতি নির্যাতন ইসলাম দৃঢ়ভাবে নিষিদ্ধ। আমরা তাদের ভাই-বোন। আমরা চাই, তারা আমাদের ভাই-বোন হিসেবে থাকুক। আমরা সবাইকে আহ্বান জানাই, যেন কোনো অবস্থাতেই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট না হয়।’