জয়নুল আবেদিন শাহেদ এখন আর কিছু মনে রাখতে পারে না। ১৬ বছরের এই ছেলেটি কোরআনের হাফেজ, পড়াশোনা করছিল দশম শ্রেণিতে। চট্টগ্রামের পটিয়ায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশ নিয়ে গত ৪ আগস্ট মাথায় গুরুতর আঘাত পায় সে। অস্ত্রোপচার শেষে অচেতন ছিল প্রায় দুই সপ্তাহ। সেই আঘাতের পাঁচ মাস পেরিয়ে গেলেও এখনো কোনো সহযোগিতা পৌঁছায়নি তার কাছে।
জুলাই আন্দোলনে অংশ নিয়ে পা ও কোমরে এক শর বেশি ছর্রা গুলি বিদ্ধ হয়েছেন সিএনজিচালিত অটোরিকশাচালক মোহাম্মদ সেলিম। অনেকটা অবশ হয়ে বেঁকে গেছে ডান পায়ের পাতা। কোনোরকমে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে কয়েক কদম হাঁটাচলা করলেও পেছনে সাপোর্ট ছাড়া স্থির হয়ে বসতে পারেন না। পাঁচ মাস ধরে অভাব-অনটনে চলছে তাঁর সংসার। তাঁর হাতেও পৌঁছায়নি জুলাই স্মৃতি ফাউন্ডেশনের কোনো সহযোগিতা।
আন্দোলন চলাকালে ৫ আগস্ট রাজধানীর চানখাঁরপুলে পুলিশের গুলিতে আহত হয়ে পাঁজরের হাড় ভেঙে যায় হাবীবুল্লাহ হামীমের। ঢাকা আলিয়া মাদ্রাসার ফাজিল দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী হামীমের বাড়ি চট্টগ্রামের সাতকানিয়া উপজেলায়। বর্তমানে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তাঁর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আন্দোলনে শহীদ ও আহতদের সহায়তা দেওয়ার জন্য প্রতিষ্ঠিত ‘জুলাই স্মৃতি ফাউন্ডেশনে’ আবেদন করেও কোনো সহযোগিতা পাননি তিনি।
শাহেদ, সেলিম ও হাবীবুল্লাহ হামীমের মতো অনেকেই রয়েছেন, যাঁরা আন্দোলনে আহত হয়েও এখনো কোনো সহযোগিতা পাননি। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পাঁচ মাস পার হয়ে গেলেও শহীদ পরিবার ও আহতদের সহায়তার কাজ শেষ করতে না পারাকে ‘ব্যর্থতা’ হিসেবে দেখছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন অনেকেই।
শহীদ পরিবার ও আহতরা সহায়তা না পাওয়ার কারণ হিসেবে আমলাতান্ত্রিক জটিলতাকে দায়ী করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) সাবেক শিক্ষার্থী ও অ্যাকটিভিস্ট আজহার উদ্দিন অনিক। তিনি বলেন, ‘আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে আন্দোলনে শহীদ ও আহতদের সহায়তা ঠিকভাবে পৌঁছানো হচ্ছে না।
একই সঙ্গে জুলাই স্মৃতি ফাউন্ডেশনে যাঁরা কাজ করছেন, তাঁদের কোনো ত্রুটি আছে কি না, সেটা দেখাও দরকার। তবে আমাদের আমলাতন্ত্রের দিকে আঙুল তোলা জরুরি।’
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শহীদ ও আহতদের পরিবারকে স্বাস্থ্যসেবা, আর্থিক সহায়তা এবং দীর্ঘমেয়াদি সহায়তা দেওয়ার বিষয়কে সামনে রেখে ২০২৪ সালের ১০ সেপ্টেম্বর ‘জুলাই স্মৃতি ফাউন্ডেশনের’ কার্যকরী পরিষদের অনুমোদন দেয় সমাজসেবা অধিদপ্তর। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে সভাপতি ও শহীদ মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধের যমজ ভাই মীর মাহবুবুর রহমানকে (স্নিগ্ধ) সাধারণ সম্পাদক করে সংস্থাটির সাত সদস্যের কার্যনির্বাহী পরিষদ গঠন করা হয়। পরবর্তী সময়ে ২১ অক্টোবর ফাউন্ডেশনের দ্বিতীয় সভায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক সারজিস আলমকে সাধারণ সম্পাদক করা হয়। মীর মাহবুবুর রহমান স্নিগ্ধকে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তবে ব্যর্থতা নিয়ে সমালোচনার মুখে গতকাল বুধবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক এক পোস্টে সারজিস জানান, তিনি জুলাই স্মৃতি ফাউন্ডেশনের ‘সাধারণ সম্পাদক’ পদে আর নেই।
রাজধানীর শাহবাগের হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের পাশে অবস্থিত জুলাই স্মৃতি ফাউন্ডেশনে বর্তমানে কাজ করছেন ৩৫ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী। তাঁরা আহতদের ডেটাবেইস তৈরি, সহায়তার জন্য তথ্য নেওয়া ও সংরক্ষণ করার কাজ করছেন। ফাউন্ডেশনের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ভ্যারিফায়েড শহীদের সংখ্যা ৮২৬ জন আর আহতের সংখ্যা ১১ হাজার ৩০০ জন। ফাউন্ডেশন থেকে ৫ লাখ টাকা করে ৬৪৭টি শহীদ পরিবার এবং ১ হাজার ৮০৭ জন আহতকে ১ লাখ টাকা করে আর্থিক সহযোগিতা করা হয়েছে।
জুলাই স্মৃতি ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে জানানো হয়, সহায়তা পাওয়ার জন্য শহীদের ক্ষেত্রে মৃত্যুসনদ লাগবে। যদি তা না থাকে তাহলে স্থানীয় প্রশাসনের একটি প্রত্যয়নপত্র, শহীদের জাতীয় পরিচয়পত্র বা জন্মনিবন্ধন সনদের কপি, যিনি নমিনি হবেন তাঁর পরিচয়পত্র বা জন্মনিবন্ধনের কপি, সন্তানের ক্ষেত্রে বাবা-মায়ের পরিচয়পত্র বা জন্মনিবন্ধনের কপি, যদি স্ত্রী থাকে তাহলে তাঁর পরিচয়পত্র বা জন্মনিবন্ধন সনদের কপি লাগবে। আহত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে ফাউন্ডেশনের একটি ফরম পূরণ করতে হবে। এ ছাড়া যে হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন, সেখানকার চিকিৎসকের সত্যায়িত কপি, হাসপাতালে ভর্তির ফরম বা চিকিৎসকের সত্যায়নসহ ছাড়পত্র এবং আহত ব্যক্তি বা নমিনির পরিচয়পত্র বা জন্মনিবন্ধন সনদের কপি লাগবে।
সমাধান চেয়ে নাগরিক কমিটির চিঠি
এদিকে জুলাই অভ্যুত্থানে আহত ব্যক্তি এবং শহীদ পরিবারের সদস্যদের সহায়তা পাওয়ার ক্ষেত্রে প্রক্রিয়াগত জটিলতা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে জাতীয় নাগরিক কমিটি। এসব জটিলতার সমাধান চেয়ে গতকাল বুধবার ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মীর মাহবুবুর রহমান স্নিগ্ধকে চিঠি দিয়েছে সংগঠনটি।
চিঠিতে এই সমস্যা দ্রুত সমাধান করার জন্য কী কী পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন, তা সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চেয়েছে নাগরিক কমিটি। ফাউন্ডেশনের হেল্পলাইনে ফোন করে কথা বলার সময়ে বা অফিসে এসে সরাসরি যোগাযোগের সময় অশোভন এবং অবজ্ঞাপূর্ণ আচরণ; সহায়তা পাওয়ার যোগ্যতা নিয়ে বিভ্রান্তি, দীর্ঘসূত্রতা, বিদেশে চিকিৎসাসহ অন্যান্য বিষয়ে দ্রুত সমাধান করার জন্য সরাসরি আলোচনায় কথা বলতে চায় নাগরিক কমিটি।
চিঠির বিষয়ে জাতীয় নাগরিক কমিটির দপ্তর সম্পাদক মনিরা শারমিন আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘চিঠি জুলাই স্মৃতি ফাউন্ডেশনের অফিসের মানবসম্পদ বিভাগে পৌঁছানো হয়েছে, একই সঙ্গে চেয়ারম্যান ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও গভর্নিং বডির কাছে অনুলিপি পৌঁছে দেওয়া হয়েছে’।