ইন্টারন্যাশনাল অ্যাটমিক এনার্জি এজেন্সি বা আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা বলেছে, জলবায়ু পরিবর্তনের চরম প্রভাব সত্ত্বেও বাংলাদেশ ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্য চাহিদা মেটাতে ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়েছে। গত বছর প্রকাশিত আইএইএ বুলেটিনের এক প্রতিবেদনে এ বিষয়টি উল্লেখ করে সংস্থাটি।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশ একটি জলবায়ু সংকট প্রবণ দেশ। যেখানে বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, ঝড় এবং খরার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের আশঙ্কা সব সময়ই থাকে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দেশের কৃষি খাত বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। উপকূলীয় অঞ্চলের ১০ লাখ হেক্টরের বেশি জমি লবণাক্ততার কারণে চাষাবাদের অনুপযুক্ত হয়ে পড়েছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে খাদ্য উৎপাদন প্রক্রিয়াকে মানিয়ে নেওয়ার লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা (আইএইএ) বাংলাদেশের সঙ্গে কাজ করছে। এই উদ্যোগের অংশ হিসেবে, তারা এমন উচ্চমানের এবং উচ্চফলনশীল ফসলের জাত উদ্ভাবনে সাহায্য করছে, যা চরম আবহাওয়া পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে পারে।
ধান বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ ফসল। তবে, চরম আবহাওয়া কিংবা রোগবালাই প্রায়ই পুরো ফসল ধ্বংস করে দিতে পারে। তাই কৃষকদের এমন নতুন ফসলের জাতের প্রয়োজন, যা প্রতিকূল পরিবেশেও উৎপাদন সম্ভব।
১৯৭১ সাল থেকে আইএইএ এবং জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) যৌথভাবে বাংলাদেশের কৃষি সমস্যাগুলো সমাধানে কাজ করছে। তাদের কাজের মধ্যে রয়েছে—প্রশিক্ষণ, ফেলোশিপ, বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ এবং গবেষণাগার উন্নত করতে সরঞ্জাম সরবরাহ। ২০২৩ সালে তারা ‘এটমস ফর ফুড’ নামের একটি উদ্যোগ চালু করে। যার লক্ষ্য কৃষিক্ষেত্রে যৌথ কাজকে আরও শক্তিশালী করা এবং খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার এগ্রিকালচার (বিনা) এবং আইএইএর সহযোগিতায় এখন পর্যন্ত ৮৫টি নতুন ফসলের জাত উদ্ভাবিত হয়েছে। এর মধ্যে একটি হলো বিনা ধান-১৪। যা পরমাণু প্রযুক্তির মাধ্যমে মাত্র চার বছরে তৈরি হয়েছে। যেখানে সাধারণত একটি নতুন ফসলের জাত উদ্ভাবনে ৮–১২ বছর সময় লাগে।
বিনা ধান-১৪ তাপমাত্রার তারতম্য সহ্য করতে পারে এবং এর ফলনকাল ১১০–১২০ দিন, যা সাধারণত ১৪০–১৫০ দিন হয়। এর ফলে অন্য ফসল বা শাকসবজি চাষের জন্য অতিরিক্ত সময় পাওয়া যায়। এই জাত প্রতি হেক্টরে প্রায় ৭ টন ধান উৎপাদন করে, যা বৈশ্বিক গড় উৎপাদনের তুলনায় প্রায় ৭৫ শতাংশ বেশি।
বিনা প্ল্যান্ট মিউটেশন ব্রিডিং পদ্ধতি ব্যবহার করে লবণাক্ততা সহনশীল ধানের জাতও উদ্ভাবন করেছে, যা উপকূলীয় অঞ্চলের কৃষকদের জন্য আশার আলো দেখাচ্ছে। ইতিমধ্যে দুটি লবণাক্ততা সহনশীল ধানের জাত বাজারে এসেছে, যার মাধ্যমে ৪০–৫০ শতাংশ পতিত জমি এখন চাষযোগ্য হয়ে উঠেছে। এর ফলে খাদ্য নিরাপত্তা এবং কৃষকদের আয় দুটোই বৃদ্ধি পেয়েছে।
আইএইএ—এর এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় বিভাগের পরিচালক ডেং গে বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যাগুলো সমাধানে পরমাণু প্রযুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশের ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি এবং খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আইএইএ কাজ করে যাচ্ছে।’
প্ল্যান্ট মিউটেশন ব্রিডিং হলো একটি পরমাণু পদ্ধতি। যেখানে ফসলের বীজ, ডালপালা বা পাতায় গামা রশ্মির মতো বিকিরণ প্রয়োগ করা হয়। এতে প্রাকৃতিক মিউটেশনের প্রক্রিয়া দ্রুততর হয়। এরপর ওই বীজ থেকে নতুন গাছ উৎপন্ন করা হয় এবং গাছগুলোর মধ্যে ভালো বৈশিষ্ট্যগুলো বাছাই করা হয়।
এই নতুন জাতগুলো বাংলাদেশের সাড়ে ষোলো কোটি মানুষের খাদ্য চাহিদা পূরণে সাহায্য করছে, যাদের এক-তৃতীয়াংশ এখনো খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে রয়েছে। এসব উদ্ভাবন বাংলাদেশকে বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম ধান উৎপাদক এবং ভোক্তা হিসেবে তার অবস্থান ধরে রাখতে সহায়তা করছে।
নাটোরের লালপুরের কৃষক আব্দুস সালাম বলেন, ‘মিউটেশন ব্রিডিং আমাদের জন্য আশার আলো। নতুন ডাল জাতগুলো পুষ্টি নিরাপত্তা, আয় এবং জীবিকা নিশ্চিত করছে।’
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় এবং পরিবেশ রক্ষা ও পুনরুদ্ধারের জন্য পরমাণু প্রযুক্তি ব্যবহার করে আইএইএ কাজ করে যাচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে—গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ কমানো, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের সঙ্গে খাপ খাওয়ানো এবং এর নেতিবাচক প্রভাব পর্যবেক্ষণ করা।