সাংবাদিকদের সর্বনিম্ন বেতন নির্ধারণের কথা উল্লেখ করে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেছেন, ‘আমি ওয়েজবোর্ডের বিরোধী না, তবে তার আগে আমাদের বেসিক মিনিমাম পেমেন্টটা ঠিক করতে হবে। এটা পুরো পৃথিবীর বেশির ভাগ দেশেই আছে। আমাদের দেশের গার্মেন্টস কর্মীদের জন্যও আছে। নৌ পরিবহন শ্রমিকদের জন্য আছে। সাংবাদিকদেরও এ রকম করতে হবে যে এর নিচে দেওয়া যাবে না এবং তাঁদের ((সাংবাদিক) সেফটি ইকুইপমেন্ট দিতে হবে।’
আজ শুক্রবার সন্ধ্যায় রাজধানীর জাতীয় প্রেস ক্লাবের তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া হলে বাংলাদেশ ফ্রি প্রেস ইনিশিয়েটিভ আয়োজিত ‘কেমন গণমাধ্যম চাই’ শীর্ষক আলোচনা সভায় তিনি এসব কথা বলেন।
শফিকুল আলম বলেন, ‘আমাদের সাংবাদিকদের খুবই কম বেতন দেওয়া হয়। এটা মানবেতর জীবনযাপন। এটা কল্পনা করা যায় না। এই জায়গায় আমাদের ইউনিয়নের লিডাররা বছরের পর বছর ফেল করেছে। আমাদের যেই ছেলেটা সাংবাদিকতায় আসবে তাঁকে আমরা দিচ্ছি ৫ হাজার টাকা, ১০ হাজার টাকা। এটা (সাংবাদিকতা) একটা নেশার মতো। সে তার নাম ছাপায় দেখতে চায়, একটা গল্প বলতে চায়। এই নেশার কারণেই আসে। আর এই আসার কারণেই তাকে ট্র্যাপে ফেলছে মালিকেরা। আজকে এই যে প্রিয় মারা গেল বা হাসান মেহেদী মারা গেল, এর জন্য খুনি হাসিনা যেমন দায়ী তেমনি কিছুটা হলেও ব্লেম মালিকদের। আমরা যারা সাংবাদিকতা করি তারা কী আমাদের সেফটি ইকুইপমেন্ট দিচ্ছেন? আমরা কী একটা হেলমেট পাচ্ছি, আমরা কী একটা বুলেটপ্রুফ ভেস্ট পাচ্ছি? এটাতো বেসিক মিনিমাম জিনিস। বাইরে (দেশের বাইরে) এগুলো ছাড়া সাংবাদিকতা করতেই দেয় না।’
সর্বনিম্ন বেতন নির্ধারণের জন্য সবার একযোগে আওয়াজটা তোলা উচিত মন্তব্য করে প্রেস সচিব বলেন, ‘আমাদের প্রত্যেকটা প্রেসক্লাব, রিপোর্টার্স ইউনিটের একযোগে এই আওয়াজটা তোলা উচিত যে আমাদের বেতনের জায়গায় যেই (মিডিয়া মালিক) সাংবাদিকতা করতে আসুক না কেন সেটা আন্ডারগ্রাউন্ড পত্রিকা হোক বা ওয়েবসাইটই হোক তাঁকে একটা ভালো রকমের বেসিক মিনিমাম পেমেন্ট দিতে হবে। আর যদি এর নিচে দেন তাহলে জার্নালিজম করতে আইসেন না। জার্নালিজম করতে হলে আপনার টাকা খরচ করতে হবে। আপনি এসে হাতে একটা প্রেস কার্ড ধরিয়ে দিলেন বা একটা আইডি কার্ড ধরিয়ে দিয়ে বললেন সাংবাদিকতা করে খাও, এটা যাতে না হয়। এটা খুবই প্রকট হচ্ছে গ্রাম অঞ্চলে। অনেক টাকার মালিক তাদের জেলা প্রতিনিধিদের হয়তো দুই হাজার টাকা দিচ্ছেন বা দিচ্ছেনই না। কার্ড দিয়ে বলছেন তুমি করে খাও। এ রকম মানুষের মুখ উন্মোচন করা উচিত।’
তিনি বলেন, ‘আপনারা নিশ্চিত থাকেন নতুন বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদ বিরোধী নতুন সাংবাদিকতা হবে। যাতে বাংলাদেশে আরেকটা ফ্যাসিবাদ না তৈরি হয়। হাসিনা একটা মনস্টার চলে গেছে, আরেকটা মনস্টার যাতে না তৈরি হয় সেটার ব্যাপারে আমাদের সবার শপথ নিতে হবে।’
আন্দোলনে নিহত হওয়া সাংবাদিকদের নিয়ে তিনি আরও বলেন, গত জুলাই-আগস্টে আমাদের সাংবাদিকেরা যেরকম সাংবাদিকতা করেছেন সেটা বাংলাদেশের ইতিহাসে আমরা দেখি নাই। আমি বলব বাংলাদেশের ইতিহাসে এটা সাংবাদিকদের জন্য একটা গর্বিত মুহূর্ত। আর যেসব সাংবাদিকসহ যারা মারা গেলেন, আমি আসলে মারা গেলেন বলব না, যারা খুন হলো সেই গল্পগুলো আমরা তখনই শুনেছি। ১৯৭১ এর পর থেকে ১৯৭২ থেকে এই পর্যন্ত একটা ইভেন্টে এত সাংবাদিক কখনো মারা যায়নি। সাতজন সাংবাদিক মারা গেছেন, শহীদ হয়েছেন। আমার মনে হয় এটা আমাদের প্রত্যেকটা প্রেসক্লাবে, রিপোর্টারদের যতগুলো অ্যাসোসিয়েশন আছে সব জায়গায় এদের নামটা লিখে রাখা উচিত সোনার অক্ষরে।’
বাংলাদেশ সাংবাদিক কল্যাণ ট্রাস্টের ব্যবস্থাপনা সম্পাদক এম আব্দুল্লাহ বলেন, আন্দোলনে সাংবাদিকদের ভূমিকা যে কতটা তা বলে বোঝানো যাবে না। এরা কিন্তু কেউ তারকাখ্যাত সাংবাদিক না তবুও তারা কাজ করে গিয়েছেন সম্মুখে গিয়ে। যারা কাজ করে গেছেন যারা মারা গিয়েছেন আমরা কিন্তু তাদের কথা বলছি না। গত ১৫ বছরে ৬১ জন সাংবাদিক শহীদ হয়েছেন। এর মধ্যে সাগর রুনিও আছে, যার শেষ হয়েছে হাসান মেহেদী, প্রিয়দের মাধ্যমে।
ছেলের স্মৃতিচারণ করে শহীদ সাংবাদিক তাহির জামান প্রিয়র মা সামসি আরা জামান বলেন, ‘এক সময় আমরা সিনেমাটোগ্রাফি বা ফটোগ্রাফিকে ক্যারিয়ার হিসেবে নিতাম না। কারণ যেহেতু আমরা এই সমন্ধে বুঝতাম না। কিন্তু আমি আজকে আমার ছেলের কাজের জন্য গর্বিত।’
তিনি বলেন, ‘প্রিয় অল্প বয়সে বিয়ে করেছে। আমি বলেছিলাম তুমি ভুল করেছ। এখন ভালো লাগলেও অভাব আসলে সেটা আর ভালো লাগবে না। তারপর সে অনলাইন পত্রিকা দ্যা রিপোর্টে চাকরি নেয়। তার বেতন ছিল ১৪ হাজার টাকা। পরিবার নিয়ে একটি মানুষ ঢাকার শহরে ১৪ হাজার টাকায় কীভাবে চলে। তাদের যে পরিমান খাটুনি হয় সে অনুযায়ী তাদের বেতন কিছুই না। আমি মনে করি সংবাদকর্মীদের বেতন বাড়ানো হোক। আমার মনে হয় সংবাদের অফিসগুলোর সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো হোক। তাহলে কর্মীরা আরও ভালো কাজ করতে পারবে। তাদের পুষ্টিকর খাবার দেওয়া দরকার। কারণ সারা দিন তারা ঘুরে বেড়ায়। তাদের যে বেতন, তারা কী খাবে নাকি সংসার চালাবে?
শহীদ প্রিয়র মা বলেন, ‘আমার ছেলের মতো যে সাংবাদিক বা যে সন্তানগুলোকে মারা হলো, আমার মনে হয় তাদের না মারলেও হতো। আর এই চার মাসে সরকার কাজ করতে পারছে না। কারণ এখন যেসব মিডিয়া আছে সবার মাথায় আগের লোকজনই আছে। আমি সংবাদমাধ্যমের সংস্কার চাই।’
বাংলাদেশ ফ্রি প্রেস ইনিশিয়েটিভের আহ্বায়ক ইয়াসির আরাফাতের সভাপতিত্বে ও যুগ্ম আহ্বায়ক সিলমি সাদিয়ার সঞ্চালনায় এ সময় আরও উপস্থিত ছিলেন শহীদ সাংবাদিক শাকিল হোসেনের বাবা মো. বেলায়েত হোসেন, শহীদ সাংবাদিক প্রদীপ কুমার ভৌমিকের ছেলে সুজন কুমার ভৌমিক, শহীদ সাংবাদিক হাসান মেহেদীর বাবা মোশারেফ হোসেন হাওলাদার প্রমুখ।