বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকা ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি ঘিরে গতকাল সোমবার সারা দেশে ব্যাপক সহিংসতা হয়েছে। এদিন সাত মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী এবং ২২ সংসদ সদস্যের (এমপি) বাড়িতে হামলা, ভাঙচুর ও আগুন দেওয়া হয়েছে। তাণ্ডব চালানো হয়েছে সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের বাড়িতে। এ সময় ভাঙচুর ও পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে বাড়ির আসবাবপত্র। এ ছাড়া রাজধানীসহ বিভিন্ন স্থানে আওয়ামী লীগের কয়েক শ নেতা-কর্মীর বাড়িঘর ভাঙচুর ও আগুন দেওয়া হয়েছে। হামলায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে দলটির অনেক কার্যালয়।
রাজধানীতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসায় হামলা
শেখ হাসিনা পদত্যাগ করার খবর ছড়িয়ে পড়ার পরপরই রাজধানীতে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে হামলা হয়। ভাঙচুর করা হয়েছে ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগ সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়, বিভিন্ন থানা, ওয়ার্ড কার্যালয়ও। গতকাল বিকেল ৪টার দিকে কারওয়ান বাজারে মৎস্য আড়তের পাশে জাতীয় শ্রমিক লীগের কার্যালয় ভাঙচুর করা হয়।
এর আগে দুপুরের পরপরই গুলশানে শেখ হাসিনার বেসরকারি বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের বাসভবনে হামলা হয়। বেলা সাড়ে ৩টার দিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের সরকারি বাসভবনে হামলা ও ভাঙচুর করেন আন্দোলনকারীরা। বাড়িতে আগুনও দেওয়া হয়।
এদিকে জাতীয় সংসদ এলাকায় থাকা স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী, ডেপুটি স্পিকার শামসুল হক টুকু, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, চিফ হুইপ নূর-ই-আলম চৌধুরী, হুইপ ইকবালুর রহিম, আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক, সাবেক পানিসম্পদ উপমন্ত্রী এ কে এম এনামুল হক শামীমের সরকারি বাসভবনে হামলা, ভাঙচুর করা হয়। সেখানে লুটপাটও করা হয়।
সংসদের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা এক কর্মকর্তা আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘হামলায় কী ধরনের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তা আমরা জানি না। আজকে (মঙ্গলবার) বিষয়টি দেখার পর ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ জানা যাবে।’
৭ মন্ত্রী ও ২৬ এমপির বাড়িতে ভাঙচুর-আগুন
চাঁদপুরে সমাজকল্যাণমন্ত্রী দীপু মনি, মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জে কৃষিমন্ত্রী উপাধ্যক্ষ আব্দুস শহীদ, মেহেরপুরে জনপ্রশাসনমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন, নাটোরে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক ও সিলেটে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী শফিকুর রহমান চৌধুরীর বাসভবনে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে।
ময়মনসিংহ-৭ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য হাফেজ রুহুল আমিন মাদানীর বাসা ও ত্রিশাল অটোরিকশাস্ট্যান্ড-সংলগ্ন পেট্রোলপাম্পে ভাঙচুর চালানো হয়। পাবনায় জেলা আওয়ামী লীগ অফিস, বাসা, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, বাস কাউন্টার ও গ্যারেজে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর এবং অগ্নিসংযোগ করা হয়।
দিনাজপুর শহরের বাসুনিয়াপট্টি এলাকায় আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে হামলা হয়েছে। বিরামপুর পৌর শহর ও নবাবগঞ্জে উপজেলা আওয়ামী লীগ অফিস ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুরে উপজেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে ব্যাপক ভাঙচুর করা হয়।
লালমনিরহাটে তিন সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগ নেতাদের বাসা ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। বরগুনার আমতলীতে উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতির বাসভবনে আগুন এবং বঙ্গবন্ধুর ম্যুরালসহ ১০টি স্থাপনায় ভাঙচুর করা হয়েছে। চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জে উপজেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়, মেয়রসহ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ও যুবলীগের কার্যালয় ভাঙচুর হয়েছে।
আবদুল হামিদের বাসভবনে হামলা
সাবেক রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের কিশোরগঞ্জের বাসভবনে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। বিকেলে জেলা শহরের খরমপট্টি এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। এ সময় বাসার কিছু মালামাল বাইরে এনে সেখানে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। এ ছাড়া বাসার বিভিন্ন মালপত্র মানুষ হাতে হাতে করে নিয়ে যায়। জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশফাকুল ইসলাম টিটুর বাসাও ভাঙচুর করা হয়। ভাঙচুর করা হয়েছে জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কার্যালয়।
বরিশালে এমপি হাসানাতের বাসভবনে আগুন
বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি বঙ্গবন্ধুর ভাগনে সংসদ সদস্য আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহর কালীবাড়ি রোডের বাড়িতে আগুন দেওয়া হয়েছে। সেখানে ফায়ার সার্ভিসকে যেতে বাধা দেয় বিক্ষুব্ধরা। প্রায় এক ঘণ্টা পর সন্ধ্যার দিকে ফায়ার সার্ভিস গিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধারকারী কর্মীরা জানিয়েছেন, ওই বাড়ি থেকে তিনটি মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। আগুনে পুড়ে বীভৎস হয়ে যাওয়ায় মৃতদের পরিচয় শনাক্ত করা যাচ্ছে না। এর আগের বিক্ষুব্ধ জনতা সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাদেক আব্দুল্লাহর বাসভবন, আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমির হোসেন আমুর বাসভবনে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর করে।
রাজশাহী নগরীর সাগরপাড়া এলাকায় দৈনিক ইত্তেফাকের রাজশাহীর জ্যেষ্ঠ আলোকচিত্রী আজাহার উদ্দিনের বাসায় ভাঙচুর হয়েছে। এ ছাড়া পত্রিকার বাঘা উপজেলা প্রতিনিধি ও বাঘা প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক মো. নুরুজ্জামানের আহমদপুর গ্রামের বাড়িতে ভাঙচুর চালানো হয়।
শামীম ও সেলিম ওসমানের বাড়িতে আগুন
নারায়ণগঞ্জে হামলা ও ধাওয়ার মুখে পালিয়েছেন বহু আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী। সারা দিন শেষে রাত নেমে এলেও খণ্ড খণ্ড সহিংসতা চলে পাড়া-মহল্লায়। চাষাঢ়ায় শামীম ওসমানের দাদাবাড়ি বায়তুল আমান, উত্তর চাষাঢ়ায় সেলিম ওসমানের বাড়ি হীরা মহল, জামতলায় শামীম ওসমানের বাড়িতে হামলা ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। নারায়ণগঞ্জ ক্লাবের সাবেক সভাপতি আসিফ হাসান মানু, প্রয়াত নাসিম ওসমানের ছেলে আজমেরী ওসমানের বাড়িতে হামলা ও অগ্নিসংযোগ করা হয়।
শাহীন চাকলাদারের পাঁচ তারকা হোটেলে আগুন
যশোর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহীন চাকলাদারের মালিকানাধীন পাঁচ তারকা হোটেল জাবির ইন্টারন্যাশনালে অগ্নিসংযোগ করেছে বিক্ষুব্ধ জনতা। বিকেল ৪টার দিকে এ ঘটনা ঘটে। এ সময় হোটেলের ভেতরে অনেকে আটকা পড়ে বহু হতাহতের ঘটনা ঘটে।
শাজাহান ও নাছিমের বাড়িতে আগুন
মাদারীপুর-২ আসনের সংসদ সদস্য শাজাহান খান ও ঢাকা-৮ আসনের সংসদ সদস্য আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিমের বাড়িতে বিকেলে হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট ও আগুন দিয়েছে জনতা।
আহমদিয়াদের অর্ধশত বাড়িতে আগুন
সোমবার বিকেলে পঞ্চগড়ে বিক্ষুব্ধ জনতা আহমদিয়া সম্প্রদায়ের অর্ধশত বাড়িতে অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর ও লুটপাট করেছে। এ ঘটনায় আহমদিয়াদের অন্তত ২৫ জন আহত হয়েছেন।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, আহম্মদনগরে আহমদিয়াদের অর্ধশত পরিবারের ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে বিক্ষুব্ধ জনতা। এ সময় ধারালো অস্ত্রের আঘাতে নারীসহ আহত হয় ২০-২৫ জন আহমদিয়া। পরে সেনাবাহিনী তাঁদের উদ্ধার করে পঞ্চগড় আধুনিক সদর হাসপাতালে ভর্তি করে। আহতদের মধ্যে কয়েকজনের অবস্থা গুরুতর।