গ্রামের সুবিধাবঞ্চিত নারীদের কর্মমুখী করতে বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। তাঁদের দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে উদ্যোক্তা তৈরি করতে ‘গ্রামকেন্দ্রিক নারীদের কর্মসংস্থানমূলক প্রশিক্ষণ’ শীর্ষক একটি প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে ১ লাখ ৫০ হাজার নারীকে প্রশিক্ষিত করা হবে। সেখান থেকে ৬ হাজার নারীকে উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তোলা হবে, যাতে তাঁরা জাতীয় উন্নয়ন ও দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখতে পারেন। মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
এ বিষয়ে জাতীয় মহিলা সংস্থার পরিচালক (যুগ্ম সচিব) ড. ফারহানা আইরিছ আজকের পত্রিকা বলেন, নারীর ক্ষমতায়ন ও নারীদের সামগ্রিক এবং জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের জন্য এই প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। আশা করছি, প্রকল্পটি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির সভায় অনুমোদন হবে।
মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, চার বছর মেয়াদি এই প্রকল্পটির ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছে ৪২৫ কোটি ৫৫ লাখ টাকা। মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় আওতাধীন প্রকল্পের বাস্তবায়ন করবে জাতীয় মহিলা সংস্থা। সংস্থাটি সামাজিক সুরক্ষার আওতায় প্রকল্পের মাধ্যমে দেশের ৯৩টি উপজেলায় এই কাজ করবে। প্রকল্পটি পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে প্রকল্পটির সম্ভবতা যাচাই-বাছাই করে আগামী অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) রাখার সুপারিশ করা হয়েছে।
প্রকল্পের তথ্যমতে, নারীদের আর্থিক উন্নয়নে অংশগ্রহণের মাধ্যমে জাতীয় উন্নয়নে ভূমিকা রাখা এবং নারীর সমঅধিকার নিশ্চিতের লক্ষ্যে সরকারের অর্থায়নে প্রকল্পটি গ্রহণ করা হয়েছে। এই প্রকল্পটির কাজ শুরু হওয়ার কথা চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে। শেষ হবে ২০২৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর মাসে। এই চার বছরে প্রকল্পের আওতায় দেশের ৯৩টি উপজেলায় ২০০টি প্রশিক্ষণকেন্দ্র স্থাপন করা হবে। যার মধ্যে ১ লাখ ৫০ হাজার নারীদের ১৫টি দক্ষতা উন্নয়ন ট্রেডে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। সেখান থেকে ৬ হাজার নারীকে উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তোলা হবে। এই প্রশিক্ষিত নারীদের উৎপাদিত পণ্যের বাজারজাতকরণে সুবিধা সৃষ্টি করবে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত নারীদের উৎপাদনমুখী প্রশিক্ষণের মাধ্যমে উন্নয়নের মূলধারায় সম্পৃক্ত হবে। বাংলাদেশে দারিদ্র্য কমে আসবে। এ ছাড়া প্রকল্পের মাধ্যমে নারীদের স্বনির্ভরতা এবং স্থায়িত্ব অর্জন হবে। এর ফলে টেকসই উন্নয়নে স্থায়ী ভূমিকা পালন করবে।
নারী ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব মমতাজ আহমেদ বলেন, দেশের নারী-পুরুষের বৈষম্য দূরকরণের লক্ষ্যে এই প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। নারীদের পাশাপাশি নতুন করে কিশোরীদের শিক্ষা, নারী উদ্যোক্তা সৃষ্টি এবং নারীদের জন্য টেকসই জীবিকা তৈরি করার জন্য বেশ কিছু প্রকল্প নেওয়া হয়েছে।
জনশুমারি ও গৃহগণনা ২০২২ সালের তথ্য অনুযায়ী, দেশের মোট জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৫১ লাখ ৫৮ হাজার ৬১৬। এর মধ্যে পুরুষ ৮ কোটি ১৭ লাখ ৬৯ হাজার ২৬৬, আর নারী ৮ কোটি ৩৩ লাখ ৮১ হাজার ২২৬ জন। অর্থাৎ দেশে পুরুষের চেয়ে নারী বেশি ১৬ লাখ ১১ হাজার ৯৬০ জন। দেশের মোট জনসংখ্যার ৬৮ দশমিক ৩৪ শতাংশ মানুষ পল্লিতে বসবাস করে। আর ৩১ দশমিক ৬৬ শতাংশ মানুষ বাস করে শহরাঞ্চলে।
বাংলাদেশে কর্মসংস্থানে নারীর অংশগ্রহণের হার ৪০ শতাংশের নিচে। বেশির ভাগ নারী এখন পড়াশোনা করলেও কর্মসংস্থানে আসছে না। পারিবারিক ও সামাজিক প্রতিবন্ধকতা তাদের পিছিয়ে রাখছে। বিশেষ করে বাল্যবিবাহ বড় ক্ষতি করছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) শ্রমশক্তি জরিপ-২২ বলছে, ২০১৬ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ছয় বছরে দেশে ৫৭ লাখ দেশের নারী কর্মে যুক্ত হয়েছেন। বর্তমানে ২ কোটি ৫৭ লাখ ৭০ হাজার নারী কর্মজীবী হিসেবে অর্থনীতির চাকা সচল রেখেছেন। শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণের হার ৪২.৭৭ শতাংশ।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের (বিআইআইএসএস) গবেষণা পরিচালক অর্থনীতিবিদ মাহফুজ কবির বলেন, অর্থনীতির উদীয়মান খাতগুলোতে শুরু থেকেই নারীর বেশি বেশি অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা দরকার।
শ্রমবাজারে গ্রামীণ নারীর অংশগ্রহণের হার শহরের নারীর তুলনায় বেশি। পোশাক খাত ছাড়াও এখন হোটেল, রেস্তোরাঁ, যোগাযোগ খাত, রিয়েল এস্টেট সেবা, টেলিকমিউনিকেশন, ব্যাংকিং ও বিমা খাতে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ছে। দেশের বাইরে থেকে রেমিট্যান্স পাঠিয়েও অর্থনৈতিক সংকটে হাল ধরেছেন নারীরা।
বিবিএসের জরিপে দেখা যায়, ৩০ বছরের কম বয়সী প্রায় ১ কোটি ৩২ লাখ ৬০ হাজার নারী শ্রমশক্তিতে যুক্ত রয়েছেন, যা কর্মে নিয়োজিত নারীর অর্ধেকের বেশি। এর মধ্যে ১ কোটি ১৫ লাখ ৭৩ হাজার নারী গ্রামের। তবে সব ক্ষেত্রে পুরুষের চেয়ে নারী বেতন কিছুটা কম পান। জরিপে দেশে পুরুষের গড় আয় দেখানো হয়েছে ১৪ হাজার ১৮০ টাকা। নারীর গড় আয় ১১ হাজার ৯৩ টাকা।