বিনা মূল্যের পাঠ্যবই
প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের পাঠ্যবইয়ের ইতিহাস বিষয়ে বড় পরিবর্তন এসেছে। যুক্ত হয়েছে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেশত্যাগ এবং ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান। এ ছাড়া স্বাধীনতার ঘোষণাসহ বেশ কিছু বিষয়ে সংযোজন-বিয়োজন করা হয়েছে।
গুরুত্বের সঙ্গে স্থান পেয়েছেন জুলাই অভ্যুত্থানের শহীদ আবু সাঈদ ও মুগ্ধ। বিভিন্ন শ্রেণির পাঠ্যবই থেকে বাদ পড়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে একাধিক লেখা ও গল্প।
এবার সব মিলিয়ে ৪০ কোটি ১৫ লাখ ৬৭ হাজার ২০২টি বিনা মূল্যের পাঠ্যবই ছাপানো হচ্ছে। এগুলোর মধ্যে মাধ্যমিক স্তরের জন্য ৩০ কোটি ৯৫ লাখ ৪১ হাজার ৪৮৬টি এবং প্রাথমিক স্তরের জন্য ৯ কোটি ১৯ লাখ ৫৪ হাজার ৩৫৫টি বই। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর অন্তর্বর্তী সরকার পুরোনো শিক্ষাক্রমের আলোকে শিক্ষার্থীদের পাঠ্যবই দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। সে জন্য ৬৯১টি পাঠ্যবই পরিমার্জন করা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে ৪৪১টি পাঠ্যবই ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে।
যুক্ত হয়েছে শেখ হাসিনার দেশত্যাগ
নবম ও দশম শ্রেণির বাংলা সাহিত্য বইয়ে নতুন যুক্ত ‘আমাদের নতুন গৌরবগাঁথা’ নামের গদ্যটি ২০২৪ সালের বৈষম্য-বিরোধী ছাত্র আন্দোলন নিয়ে লেখা। এতে ৫ আগস্ট ও শেখ হাসিনার দেশ-ত্যাগের ঘটনা তুলে ধরা হয়েছে। বলা হয়েছে, ‘সেদিন ৫ই আগস্ট ২০২৪-৩৬ শে জুলাই। বাংলাদেশের ক্যালেন্ডার জুলাইতে থেমে গেছে। শুধু দেশ নয় সারা দুনিয়ার মানুষ তাকিয়ে আছে বাংলাদেশের দিকে। আন্দোলনকারী ছাত্র- জনতা এক দফা দাবি পেশ করেছে।’
গদ্যটিতে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, ‘সারা দেশ থেকে মানুষ ঢাকায় ছুটছে। ঘেরাও করবে গণভবন। মূলোৎপাটন করবে শাসনক্ষমতা আঁকড়ে থাকা ফ্যাসিবাদী শাসককে। কারফিউ উপেক্ষা করে ঢাকার উত্তরার পথে মানুষের দেখা মিলল। যাত্রাবাড়ীর দিকে মানুষ জড়ো হতে থাকল ধীরে ধীরে। নামল মানুষের ঢল। জনতা গণভবনে পৌঁছে যায় দুপুর নাগাদ। পতন অত্যাসন্ন টের পেয়ে স্বৈরাচার সরকারপ্রধান পালিয়ে যান দেশ ছেড়ে।’
জুলাই আন্দোলন নিয়ে কবিতা
সপ্তম শ্রেণির বাংলা পাঠ্যবই ‘সপ্তবর্ণা’ থেকে গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের ‘শোন একটি মুজিবরের থেকে’ ও সুনির্মল বসুর ‘সবার আমি ছাত্র’ কবিতা দুটি বাদ দেওয়া হয়েছে। যুক্ত করা হয়েছে ২০২৪ সালের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান নিয়ে হাসান রুবায়েতের কবিতা ‘সিঁথি’। কবিতাটির প্রথম কয়েকটি লাইন হলো, ‘ভাই মরলো রংপুর/ সেই রংপুরই তো বাংলাদেশ/ নুসরাতেরা আগুন দিল/ দোজখ যেন ছড়ায় কেশ/ কওমি তরুণ দাঁড়ায় ছিল/ কারবালারই ফোরাতে/ শাহাদতের আগুন দিলে/ খুনির আরশ পোড়াতে।’
এ ছাড়া ষষ্ঠ শ্রেণির ‘চারুপাঠ’ বইয়ে ‘কার্টুন, ব্যঙ্গচিত্র ও পোস্টারের ভাষা’ শিরোনামের অধ্যায়ে ২০২৪ সালের জুলাই আন্দোলনের পোস্টার যুক্ত করা হয়েছে। তবে পাকিস্তানি শাসক ইয়াহিয়া খানের বিরুদ্ধে পটুয়া কামরুল হাসানের বিখ্যাত চিত্রকর্ম ‘এই জানোয়ারটা আবার আক্রমণ করতে পারে’, পরবর্তীকালে ‘এই জানোয়ারকে হত্যা করতে হবে’ শিরোনামের চিত্রকর্ম ব্যবহার করা হয়নি। সেখানে ২০২৪ সালের অভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপট বিবেচনায় ব্যবহার করা হয়েছে হেলিকপ্টার থেকে গুলি করার একটি দৃশ্য।
পরিবর্তন এসেছে স্বাধীনতার ঘোষণা অংশে
পরিমার্জিত পঞ্চম শ্রেণির ‘বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয়’ পাঠ্যবইয়ে স্বাধীনতার ঘোষণা অংশে পরিবর্তন করা হয়েছে। নতুন বইয়ে এই অধ্যায়ের ‘১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ’ শীর্ষক লেখায় বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের ছবির পাশাপাশি মেজর জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়ার ছবি স্থান পেয়েছে। এখানে বিষয়বস্তু হিসেবে বলা হয়েছে, ‘...এ রাতেই বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করা হয়। ২৬ শে মার্চ তারিখে মেজর জিয়াউর রহমান চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা করেন। এরপর তিনি ২৭ শে মার্চ তারিখে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে আবারও স্বাধীনতার ঘোষণা দেন।’
পুরোনো বইয়ে এ-সংক্রান্ত লেখায় শুধু বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের ছবি ছিল। আর স্বাধীনতার ঘোষণা-সংক্রান্ত স্থানে লেখা ছিল, ‘এ কালরাতেই বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারের আগে অর্থাৎ ২৬ শে মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু ওয়্যারলেস বার্তায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা দেন। এর ভিত্তিতে ২৬ মার্চ শুরু হয় আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ এর বাইরে এবারের নতুন পাঠ্যবই থেকে ইতিহাসবিষয়ক আরও কিছু বিষয়বস্তু বাদ দেওয়া হয়েছে।
বাদ পড়েছে ‘ফেব্রুয়ারি গান’ ছড়া
২০২২ সালে প্রণীত পঞ্চম শ্রেণির ‘আমার বাংলা বই’ থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে লুৎফর রহমান রিটনের ছড়া ‘ফেব্রুয়ারি গান’। যুক্ত করা হয়েছে নির্মল বসুর কবিতা ‘সবার আমি ছাত্র’। একই বইয়ের বাংলাদেশের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন নিয়ে লেখা গদ্য ‘মাটির নিচে যে শহর’ বাদ দেওয়া হয়েছে। সেখানে নতুন গদ্য যুক্ত করা হয়েছে, ‘আমরা তোমাদের ভুলব না’। এই গদ্যে শহীদ তিতুমীর, শহীদ প্রীতিলতা, শহীদ আমানুল্লা মো. আসাদুজ্জামান, শহীদ মতিউর রহমান মল্লিক, শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক, শহীদ অধ্যাপক ড. মুহম্মদ শামসুজ্জোহার পরে যুক্ত করা হয়েছে শহীদ নূর হোসেন, শহীদ ডা. মিলন, শহীদ নাসির উদ্দিন জেহাদের নাম। এরপর যুক্ত করা হয়েছে ২০২৪ সালে ছাত্র আন্দোলনে শহীদ আবু সাঈদ ও শহীদ মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধের নাম।
‘পহেলা বৈশাখ’ পরিবর্তন করে ‘নববর্ষ’
দ্বিতীয় শ্রেণির বাংলা বইয়ে ‘পহেলা বৈশাখ’ গল্পটির নাম পরিবর্তন করে রাখা হয়েছে ‘নববর্ষ’। লেখা ও ছবিতে আনা হয়েছে পরিবর্তন। মঙ্গল শোভাযাত্রা বা পহেলা বৈশাখের শোভাযাত্রার ছবি বাদ দিয়ে বৈশাখের অন্য সব উপকরণের ছবি ব্যবহার করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা ‘সোনার ছেলে’ গল্প বাদ দিয়ে যুক্ত করা হয়েছে ‘দুখু মিয়ার জীবন’ গল্পটি। এই বইয়ে নতুন যুক্ত করা হয়েছে ‘সিংহ আর ইঁদুরের গল্প’।
পাঠ্যবইয়ে সংযোজন-বিয়োজনের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক এ কে এম রিয়াজুল হাসান বলেন, ‘পাঠ্যবই পরিমার্জনে আমরা নির্মোহ ইতিহাসকে গুরুত্ব দিয়েছি। অতি বন্দনা পরিহার করা হয়েছে। এ জন্য প্রয়োজনীয় সংযোজন-বিয়োজন করা হয়েছে। নতুন করে যুক্ত হয়েছে জুলাই বিপ্লব নিয়ে লেখা, গ্রাফিতি।’