Ajker Patrika
হোম > মতামত > উপসম্পাদকীয়

ধর্ষণ প্রতিরোধে রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব

স্বপ্না রেজা

ধর্ষণ প্রতিরোধে রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব

নারীর প্রতি সহিংসতা যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। তার সঙ্গে আছে অধিকার বঞ্চনা। পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থাপনা ও তার সঙ্গে যুক্ত হওয়া ধর্মীয় গোঁড়ামি নারীকে প্রতি পদে পদে অবদমিত, লাঞ্ছিত করার অন্যতম কৌশল হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। ফলে নিপীড়ন, নির্যাতন, ধর্ষণ, হত্যা, বৈষম্য ইত্যাদি নৃশংস ও মর্মান্তিক ঘটনা নারীর জীবনে অহরহ ঘটছে। এটা না বললেই নয় যে নারীর প্রতি সহিংসতা তীব্র আকার ধারণ করার নেপথ্যে যে কারণটি ভয়ংকর রকম ভূমিকা রাখছে সেটা হলো, ধর্ষণ প্রতিরোধে রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের যে স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছিল, দুঃখজনক হলেও সত্য যে সেই স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়গুলোতে ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনৈতিক চর্চা জনগণের নিরাপত্তা দিতে ও স্বার্থ সংরক্ষিত করতে পারেনি। বরং রাজনৈতিক দল ও রাজনীতিকদের স্বার্থ সংরক্ষিত হয়েছে ঘুরেফিরে। যে দল যখন ক্ষমতায় আসীন হয়েছে, সেই দল কেবল নিজেদের স্বার্থ সংরক্ষণ করে পুনরায় ক্ষমতায় আসীন হওয়ার পাঁয়তারা করেছে। ফলে তাদের ভাগ্য বদলেছে।

সাধারণ জনগণের আর্থসামাজিক নিরাপত্তা কিংবা স্বার্থ, সেই অর্থে সুরক্ষিত হয়নি এহেন রাজনৈতিক অপসংস্কৃতির কারণে। রাষ্ট্রীয় কাঠামোকে রাজনৈতিক অপসংস্কৃতি তিলে তিলে ধ্বংস করেছে। এক কথায়, সাধারণ জনগণ অরক্ষিত থেকে গেছে, যার মধ্যে নারীরা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। শিক্ষা, মেধা, জ্ঞান ও যোগ্যতায় নারীরা এগিয়ে গেলেও বৈষম্য তাদের পিছু ছাড়েনি। তার সঙ্গে যুক্ত থেকেছে নিপীড়ন, নির্যাতন, ধর্ষণ ও নৃশংস হত্যাকাণ্ডের মতো ঘটনা। যদিও বিভিন্ন সময়ে অপরাধ রোধে আইন প্রণয়ন হয়েছে কিন্তু তার প্রয়োগ ঘটেনি, ঘটতে দেখা যায়নি সেই অর্থে। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক প্রভাবে ও ছত্রচ্ছায়ায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অপরাধীরা ছাড় পেয়ে গেছে বারবার। একটা পর্যায়ে রাজনীতি হয়ে ওঠে যাবতীয় অপরাধের আশ্রয়স্থল ও অভয়ারণ্য।

আশি ও নব্বইয়ের দশকে ফতোয়ার মধ্য দিয়ে নারীকে প্রতিহত করার চেষ্টা বেশ জোরালো হয়। গ্রামগঞ্জে, মফস্বলে ফতোয়ার আধিক্য ও প্রচলন সেই সময়ে নারীকে বিভিন্ন কৌশলে বাধাগ্রস্ত করেছে, করেছে নিপীড়িত, নির্যাতিত। সেই সময়ে বেশ কিছু বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা এই প্রতিকূল পরিবেশ থেকে তৃণমূল পর্যায়ের নারীকে সাহসিকতার সঙ্গে বের হতে সহায়তা করেছে, যেটা সম্ভব হয়েছে বিভিন্ন ধরনের সচেতনতামূলক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে এবং তাদের সংগঠিত করে। সাধারণত ফতোয়া আরোপ সম্ভব হতো অল্প শিক্ষিত, নিরক্ষর, দরিদ্র নারীদের ওপর। সর্বস্তরের নারীরা তখন সংগঠিত ও একত্র হয়ে ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়াতে, স্বাবলম্বী ও আত্মনির্ভরশীল হতে শুরু করে।

যদিও নব্বইয়ের দশকের শেষে বড় ফতোয়া ছিল, নারীরা বিজয় উৎসব করতে পারবে না! ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ধর্মীয় উগ্রপন্থী তথা মৌলবাদীরা সেই সময়ে এমন ফতোয়া দিলে তৎকালীন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি দাবিদার আওয়ামী লীগ সরকার ১৪৪ ধারা জারি করে পরিবেশ-পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ ও জানমালের নিরাপত্তার অজুহাতে। তারা বেমালুম এড়িয়ে গেল মুক্তিযুদ্ধ এবং তার বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা ও সংবিধানের কথা, যেখানে সুস্পষ্টভাবে আছে নারীর অধিকারের বিষয়টি। নারীর অধিকার হরণ করে তার নিরাপত্তা বিধানের বিষয়টি যে ভয়ংকর রকম সাংঘর্ষিক ও স্ববিরোধী এবং আগামীর নারীদের জন্য প্রতিকূল পরিস্থিতির দৃষ্টান্ত হয়ে থাকতে পারে, তৎকালীন আওয়ামী সরকার তা মনে করেনি।

নারী বিজয় উৎসব করতে পারবে না, এমন ফতোয়া ও সরকারের ১৪৪ ধারা ভাঙতে সেই দিন অসংখ্য নারী ও পুরুষ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পথে পা বাড়ায়। অনেক হতাহতের ঘটনা ঘটে। বলা যায় সেই শুরু—বিভিন্ন উৎসব, উদ্‌যাপনে নারীর অংশগ্রহণে বাধাদান। একে একে পয়লা বৈশাখ উদ্‌যাপনে নারীকে হেনস্তা করা শুরু হয় এবং সেখানেও উৎসব উদ্‌যাপনে নিয়ন্ত্রণের রেখা টেনে দেওয়া হয় নিরাপত্তার অজুহাতে। সব বাধা যে দেশটির নিজস্ব সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, কৃষ্টির ওপর, সেটা বুঝবার শক্তি লোপ পেয়েছে ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনৈতিক চর্চায়।

সমাজ ও রাষ্ট্রে নারীর প্রতি যে সহিংসতার সীমাহীন বিস্তার ও ব্যাপকতা, তার জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবকেই দায়ী করা যায়। সব সরকারের আমলেই এই সদিচ্ছার অভাব ও ব্যর্থতা ছিল উল্লেখ করার মতো এবং যার ফলে দিন দিন নারীর প্রতি সহিংসতা বেড়েছে, সেই সঙ্গে সহিংসতার ধরন বদলেছে। ধর্ষকদের থাবা পড়েছে কন্যাশিশুর ওপর। ছাড় পাচ্ছে না সাত মাসের শিশুও। পৈশাচিক উপায়ে শিশুকে ধর্ষণ করা হচ্ছে। কন্যাশিশুদের নিরাপত্তাহীনতার দায় কেউই এড়াতে পারবে না, পারার কথা নয়। সব সরকারের আমলেই ধর্ষকেরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে গেছে। তাদের বিচারিক প্রক্রিয়ায় আনা হয়নি। ধর্ষণের পর হত্যা করেও স্রেফ ক্ষমতার দাপট ও প্রভাবে তারা দিব্যি সমাজের মুক্ত বাতাস ও তথাকথিত সম্মানজনক অবস্থানে থেকে গেছে! তাদের দেখে সমাজে নতুন নতুন ধর্ষক পয়দা হয়েছে।

রাজনৈতিক প্রতিশোধ, প্রতিহিংসা চরিতার্থেও গ্যাং রেপের প্রচলন ঘটেছে সমাজে। ধর্ষকেরা রাজনৈতিক পরিচয়ে ছাড় পেয়ে গেছে বারবার। মূল কথা, রাজনৈতিক, সামাজিক ও পারিবারিক প্রতিশোধ, প্রতিহিংসায় নারীর ওপর আঘাতটাই পড়েছে বারবার। আজকের যে পরিস্থিতি বা পরিণতি তা ধর্মীয় ও রাজনৈতিক অপসংস্কৃতিরই ফল। এমন ঘৃণ্য অপরাধকে নির্মূল করতে সেই অর্থে কেউ সচেষ্ট ছিল না, এখনো নেই। অনেকে মনে করেছিল পরিবর্তন বা সংস্কারের লক্ষ্যে যে শাসনব্যবস্থা কায়েম হয়েছে, অন্তত সেখানে ধর্ষণকে কঠোরভাবে প্রতিহত করা হবে। নারীর প্রতি সহিংসতা কমবে। অন্তত নিরাপত্তা নিশ্চিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে, যেহেতু দলীয় রাজনৈতিক তৎপরতার বিষয়টি এখানে থাকছে না।

কিন্তু প্রত্যক্ষ না হলেও পরোক্ষভাবে রাজনৈতিক আভাস, ইঙ্গিত দেখা গেছে। ছাত্রদের একাংশ তো সরাসরি রাজনৈতিক দলের নাম ঘোষণা করে নির্বাচনে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে। কেউ কেউ মনে করে, এমনটি না হলে ভালো হতো। চব্বিশের জুলাইয়ের ভাবগম্ভীর ও মর্যাদা অটুট থাকত। তারা শাসকের জবাবদিহি নিয়ে দেশকে একটা সুন্দর জায়গায় পৌঁছে দিতে পারত। যাহোক, ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে আপসহীন সময়ে এখন প্রকাশ্যে পথেঘাটে ধর্মীয় আচারবিধির অজুহাতে নারীকে হেনস্তা করা হচ্ছে। নারীর প্রতি বিরূপ আচরণের বহিঃপ্রকাশ ভাইরাল করা হচ্ছে, যেটা অপ্রত্যাশিত এবং সচরাচর দেখা যায়নি ইতিপূর্বে। জনগণের স্বার্থ, কল্যাণ কিংবা নিরাপত্তার চেয়ে দৃষ্টি এখন অন্যত্র, তা কিন্তু বেশ স্পষ্ট। কেউ কেউ সমালোচনা করে বলছে, এমনটি কথা ছিল না; এ তো নতুন আঙ্গিকে ফ্যাসিবাদের পুনরাবৃত্তি ।

উন্নয়ন, পরিবর্তন বা সংস্কার—যেটাই বলি না কেন—জনগণের নিরাপত্তা, স্বস্তি, শান্তি ছাড়া কখনোই সম্ভব নয়, সম্ভব হয়ওনি। ইতিহাস অন্তত তাই বলে। কন্যাশিশুর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা অপরিহার্য। কারণ, আগামীর বাংলাদেশের তারাই জননী, মানব সন্তান উৎপাদনের মূল স্তম্ভ। এই জাতির অস্তিত্ব রক্ষায় কন্যাশিশু ও নারীকে সুরক্ষিত করা ছাড়া বিকল্প কোনো পথ নেই।

লেখক: স্বপ্না রেজা

কথাসাহিত্যিক ও কলাম লেখক

ভারতের দুমুখো নীতিই সম্পর্কোন্নয়নের অন্তরায়

নির্বাচন নিয়ে সংশয় কেন

আমরা কি শুধু মৃত্যুর অপেক্ষায় থাকব

নারী বাঁচবে কী করে

এনআইডি নিয়ে নতুন প্রতিষ্ঠান নতুন বিতর্ক তৈরি করবে

শব্দের আড়ালে গল্প: ফ্যাঁকড়া

আমরা শোকাহত, ক্ষুব্ধ

দেশের হৃৎপিণ্ডে প্রচণ্ড ধাক্কা দিয়ে গেল মেয়েটি

তরুণেরাই মোড় পরিবর্তনের দিশারী

আমাদের গণতন্ত্র এবং কাঠমান্ডুর অভিজ্ঞতা