কয়েক ছত্র
বার্ধক্য হলো ষাটোর্ধ্ব জীবন। সারকোপেনিয়া হলো একধরনের পেশি ক্ষয় যা সাধারণত বার্ধক্যে ঘটে। সারকোপেনিয়া সাধারণত বয়স্ক বা পরিশ্রম না করে বসে থাকা জনগণ এবং রোগীদের প্রভাবিত করে, যাদের অন্যান্য অসুস্থতা রয়েছে। এটা মানব দেহের পেশির সিস্টেমকে প্রভাবিত করে বা শারীরিক কার্যকলাপকে ব্যাহত করে।
গভীরভাবে তাকালে আমাদের আশপাশে কিংবা পরিবার-পরিজনের মধ্যে এমন লোকজনের দেখা পাব, যাদের শরীর হাড়ের ওপর শুধু চামড়া দিয়ে মোড়ানো। এদের পেশি নেই বললেই চলে। আবার কারও কারও অল্প পরিমাণে পেশি রয়েছে, যা প্রয়োজনের তুলনায় কম। সারকোপেনিয়ায় আক্রান্ত প্রবীণদের চলাফেরা সীমিত হয়ে যায়—উঠতে-বসতে কষ্ট হয়, কিছু ধরার শক্তি কমে যায়, ধীর গতিতে হাঁটেন, পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে, দাঁড়ানোর সমস্যা, স্বাভাবিক দৈনন্দিন কাজকর্ম করতে অসুবিধা বোধ করা।
পা হলো এক ধরনের স্তম্ভ, যার ওপর মানবদেহের পুরো ওজন স্থির থাকে। মানুষের ক্রিয়াকলাপ এবং শক্তির ৭০ শতাংশ পায়ের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। প্রথমেই আমাদের পা নিয়ে চিন্তাভাবনা এবং সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি কেমন সে বিষয় নিয়ে কয়েকটি কথা বলতে চাই। আমাদের সমাজ পায়ের তেমন একটা গুরুত্ব দেয় বলে মনে হয় না। পাকে উপস্থাপন করা হয় যেভাবে—লাথি মার, লাথি মারতে ইচ্ছে করছিল, আমার পায়ের যোগ্য না, ওদিকে পা মাড়াব না, গায়ে পা লাগল কেন, পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়া-বিবাদ, আপনার পায়ে পড়ি আমাকে মাপ করে দিন, পা ধরে মাফ চাইতে হবে, পা ধরে মাফ না চাইলে মাফ হবে না, পায়ে ধরে টাকা ধার নিয়ে এখন দেওয়ার নাম নেই, আপনি তো আমাদের এলাকায় কখনো পা রাখেননি, এই এলাকায় যেন আপনার পা না পড়ে!
মোট কথা, পাকে তেমন মর্যাদার অঙ্গ হিসেবে বিবেচনা করা হয় না। অথচ পা সারা দিন আমাদের শরীরকে বয়ে বেড়ায়। আমাদের সমাজের মানিসকতা এমন—সবচেয়ে বেশি কষ্ট যে করবে সেই সবচেয়ে কম ভোগ করবে। যে কৃষক খাদ্য উৎপাদন করে তার ঘরে খাবার না পেয়ে শিশু কাঁদে! যে ট্রাক দূরদূরান্ত থেকে মালামাল বয়ে আনে, তার যত্ন তেমন একটা হয় না।
প্রত্যেক মানুষেরই প্রতিদিন অন্তত ২০ মিনিট পায়ের যত্ন নেওয়া উচিত। পায়ের যত্ন নিয়ে আমাদের মধ্যে খানিকটা অনীহা থাকলেও মুখমণ্ডলের যত্ন নিয়ে কোনো অনীহা নেই। বয়স বাড়তে থাকলে মুখেচোখে বলিরেখা চলে আসে। বলিরেখা আড়াল করতে কিংবা সারিয়ে তুলতে আমাদের মনোযোগ রয়েছে। মনোযোগের অভাব হয় পায়ের যত্ন নেওয়ার ক্ষেত্রে। সারকোপেনিয়া রোগের চিকিৎসা রিউমাটোলজিস্ট বা জেরিয়াট্রিশিয়ানরা দিয়ে থাকেন। এ রোগ নিরাময়ের চাইতে প্রতিরোধই গুরুত্বপূর্ণ।
চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ব্যায়াম, প্রোটিন ও ভিটামিন-ডি গ্রহণ করলে সারকোপেনিয়া প্রতিরোধে ভূমিকা রাখা সম্ভব। স্থূলতা এবং সারকোপেনিয়া একে-অপরকে শক্তিশালী করতে পারে। শারীরিক প্রতিবন্ধকতা, বিপাকীয় ব্যাধি এবং মৃত্যুর কারণ হতে পারে।
সারকোপেনিয়া সম্পর্কে সঠিক ধারণার অভাব মানুষকে টাইপ-২ ডায়াবেটিসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। একজন প্রবীণ ব্যক্তি তাঁর পেশি পুনর্নির্মাণ করতে পারেন না। একবার পেশির সক্ষমতা চলে গেলে তা একেবারেই চলে যায়। সাধারণত যেসব প্রবীণ নাগরিক ব্যক্তিগত সেবাযত্ন ও পরিচর্যা করার জন্য সেবাকর্মী বা সাহায্যকারী নিয়োগ দেন, তাঁরা দ্রুত দুর্বল হয়ে পড়েন।
একজন সমাজকর্মী হিসেবে সারকোপেনিয়া প্রতিরোধে নিচের পরামর্শগুলোকে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করতে পারি।
১. যতটা সম্ভব দাঁড়ানোর অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে।
২. সিঁড়ি বেয়ে ওঠানামা, হালকা দৌড়ানো, সাইকেল চালানো, নিয়মিত হাঁটা— সবই দুর্দান্ত ব্যায়াম এবং পেশির সক্ষমতা রক্ষা করতে সহায়তা করে।
৩. সারকোপেনিয়া অস্টিওপরোসিসের চেয়ে বেশি বিপজ্জনক। সতর্ক থাকতে হবে যেন আক্রান্ত ব্যক্তি পড়ে না যান।
৪. পেশির দ্রুততম ক্ষতি পায়ে ঘটে। এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ কারণ একজন ব্যক্তি বসে কিংবা শুয়ে থাকলে পা নাড়াচাড়া করেন না। এতে পায়ের পেশিগুলো প্রভাবিত হয়।
৬. আপনার পা সক্রিয় এবং শক্তিশালী রাখুন। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের পা সব সময়ই শক্তিশালী এবং সক্রিয় রাখা উচিত।
৭. প্রতিদিন হাঁটুন যতটুকু পারেন। ৭০ বছর বয়সের পরও পায়ের ব্যায়াম করা উচিত। নিয়মিত ব্যায়াম ও হাঁটার অভ্যাস জারি রাখুন।
লেখক: হাসান আলী, প্রবীণ বিষয়ে লেখক, গবেষক ও সংগঠক