হোম > মতামত

ফিরে দেখা

সেলিম জাহান

২০২৪ সালের ২৬ মার্চ বাংলাদেশ তার ৫৩তম স্বাধীনতা দিবস পার করছে। ১৯৭১ সালে ৯ মাসের একটি রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা ছিনিয়ে এনেছিলাম বিজয়ের লাল সূর্য। আমাদের স্বাধীনতা শুধু একটি ভূখণ্ডের নয়, নয় একটি মানবগোষ্ঠীর; সে বিজয় একটি চেতনার, একটি সংগ্রামের, একটি মূল্যবোধের। 

দীর্ঘদিনের সংগ্রাম এবং একটি রক্তক্ষয়ী মুক্তিসংগ্রামের মাধ্যমে বাংলাদেশ অর্জন করেছিল তার ইপ্সিত স্বাধীনতা। একটি ধ্বংসস্তূপ থেকে ফিনিক্স পাখির মতো গা ঝাড়া দিয়ে উঠেছিল দেশটি। তার পরের অর্ধ শতাব্দীতে সহস্র অন্তরায় পেরিয়ে দেশটি অর্জন করেছে এমন অর্থনৈতিক অগ্রগতি, এমন মানব উন্নয়ন এবং এমন বৈশ্বিক মর্যাদা যে সারা পৃথিবীতে বাংলাদেশ নন্দিত হয়েছে একটি ‘উন্নয়ন বিস্ময়’ হিসেবে। 

কিন্তু সেই সঙ্গে আমরা মুখোমুখি হচ্ছি নানান উন্নয়ন অন্তরায়ের, নানান সামাজিক সমস্যার। অসমতা, অর্থনৈতিক কাঠামোর নানান নাজুকতা, পরিবেশদূষণ ইত্যাদি বিষয় বাংলাদেশের উন্নয়নে অন্তরায় হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা, যূথবদ্ধতার অনুপস্থিতি, সাফল্যের মাপকাঠি হিসেবে অর্থ ও ক্ষমতার ব্যবহার, অসহনশীলতা ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের অভাব, সহিংসতার বিস্তার বাংলাদেশের নানান সামাজিক সমস্যা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। 

কিন্তু আমার সব সময় মনে হয়েছে যে বাংলাদেশের বহু সমস্যা ও অন্তরায়ের মূল কারণ আমাদের স্বাধীনতার মৌলিক মূল্যবোধ ও চেতনা থেকে বিচ্যুতি। সেই মূল্যবোধ ও চেতনা প্রোথিত ছিল চারটি জাতীয় নীতিতে—জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। জাতীয়তাবাদ আমাদের বাঙালি আত্মসত্তার জন্য আবশ্যিক শর্ত। আত্মসত্তা বোধ একটি জাতির স্বাধীনতা ও মুক্তির জন্য দরকার। গণতন্ত্র ভিন্ন স্বাধীনতা বা মুক্তিকে একটি বজায়ক্ষম ভিত্তির ওপরে প্রতিষ্ঠিত করা যায় না। সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা মানবিকা অধিকার, সামাজিক ন্যায্যতা এবং সব ধরনের সমতার জন্য অত্যাবশ্যকীয়। 

বঙ্গবন্ধুর চিন্তা-চেতনায় ‘জাতীয়তাবাদ’ ও ‘ধর্মনিরপেক্ষতার’ একটা বিশেষ স্থান ছিল। বাঙালি জাতীয়তাবাদকে তিনি ‘চরম জাতীয়তাবাদ’ হিসেবে দেখেননি, দেখেছেন বাঙালি জাতির আত্মসত্তার নির্ণায়ক হিসেবে। তেমনিভাবে বারবার আমাদের আশ্বস্ত করেছেন এই বলে যে, ‘ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়’। রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় ও সমাজজীবনে তিনি ধর্ম ও জাতীয়তাবাদকে এমন জায়গায় রেখেছেন, যেখানে বাঙালি জাতির আত্মসত্তা-অস্তিত্বে কোনো দ্বন্দ্ব না থাকে, আর ধর্ম বিষয়ে কোনো সংশয় না থাকে। পরবর্তী সময়ের সব দ্বন্দ্ব ও সংশয়ের স্রষ্টা আমরাই—বহু মীমাংসিত বিষয়কে আবার ঘোলাটে করে দিয়ে। 

বঙ্গবন্ধু সমাজতন্ত্রকে প্রথাগত শার্সিতে দেখেননি, দেখেছেন সামাজিক ন্যায্যতার দৃষ্টিকোণ থেকে। সামাজিক ন্যায্যতাকে তিনি একটি শোষণমুক্ত সমাজের অপরিহার্য প্রাক্‌শর্ত হিসেবে ভেবেছেন। তিনি গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের কথা বলেছেন, কিন্তু দুটোকেই দেখেছেন সামাজিক ন্যায্যতার একেকটি স্তম্ভ হিসেবে। তাই সত্তরের দশকের প্রথম দিকে নানা মনে ‘গণতন্ত্র’ ও ‘সমাজতন্ত্র’ বিষয়ে নানা রকমের ধোঁয়াটে ভাব থাকলেও এ বিষয় দুটোতে বঙ্গবন্ধুর ধারণা ছিল শার্সির মতো স্বচ্ছ। 

‘গণতন্ত্রকে’ তিনি শুদ্ধ একটি বিষয় হিসেবে ভাবেননি, ভেবেছেন ‘সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্র’ হিসেবে; আবার ‘সমাজতন্ত্রকেও’ একটি যান্ত্রিক মাত্রায় দেখেননি, বিবেচনা করেছেন ‘গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র’ হিসেবে এবং এ দুটোকেই সম্পৃক্ত করেছেন সামাজিক ন্যায্যতার সঙ্গে। এর পরিপ্রেক্ষিতেই তিনি ‘স্বাধীনতা’ ও ‘মুক্তির’ মধ্যে পার্থক্য করেছেন। তাঁর চেতনায় ‘স্বাধীনতা’ ও ‘মুক্তির’ ব্যঞ্জনা ভিন্ন। স্বাধীনতা এলেই মুক্তি আসে না। স্বাধীনতা অর্জন করার পরেও একটি জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে বঞ্চনা থাকতে পারে, অসাম্য থাকতে পারে, অন্যায় থাকতে পারে। এগুলো দূর করতে পারলেই তখন কেবল মুক্তি সম্ভব। সুতরাং বাঙালি জাতির সংগ্রাম শুধু স্বাধীনতাপ্রাপ্তিতে শেষ হবে না, তাকে মুক্তি নিশ্চিত করতে হবে। কারণ স্বাধীনতা মুক্তির আবশ্যকীয় শর্ত, কিন্তু পর্যাপ্ত শর্ত নয়। 

এই আদর্শিক মূল্যবোধগুলোর ওপর ভিত্তি করেই বাংলাদেশের জন্ম ও পথচলা শুরু। কিন্তু আমরা দেখেছি, ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর নিকটজনদের নৃশংসভাবে হত্যার পরে তৎকালীন রাষ্ট্রযন্ত্র এসব মূল্যবোধকে অত্যন্ত সুচিন্তিতভাবে জলাঞ্জলি দিয়েছে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে বিকৃত করা হয়েছে, ইতিহাসের বহু নিষ্পত্তিকৃত সত্যকে খুঁচিয়ে অনাবশ্যক বিতর্কের সৃষ্টি করা হয়েছে, আমাদের নতুন প্রজন্মকে বিপথগামী করার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে। 

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তো শুধু জাতির পিতাকেই হত্যা করা হয়নি, তাঁর চিন্তা-চেতনা আর মূল্যবোধ, যার ভিত্তিতে বাংলাদেশের জন্ম, সেগুলোকেও হত্যা করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। ’৭৫-পরবর্তী সময়ে বাঙালি জাতি এবং বাংলাদেশের মৌলিক চিন্তা-চেতনা ও মূল্যবোধ নস্যাৎ করার জন্য তখনকার রাষ্ট্রযন্ত্র বিবিধ প্রক্রিয়া শুরু করে, যার নানান রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক মাত্রিকতা ছিল। বঙ্গবন্ধু হত্যার পরপরই রাষ্ট্রীয় অপশক্তি তাদের অপকর্মের শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে। 

১৯৭৫-পরবর্তী সময়ে ইতিহাসের ধারা পাল্টে দেওয়ার উদ্দেশ্যে পাঁচটি চিহ্নিত কাজ করা হয়। প্রথমত: সংবিধানকে ওলট-পালট করে তা থেকে মৌলিক চার নীতির বিচ্যুতি ঘটানো, যেমন—ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্রকে বাদ দেওয়া। ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে গ্রহণ করা হয় এবং বাংলাদেশকে ইসলামী প্রজাতন্ত্রে পরিণত করার অপপ্রয়াস চালানো হয়। 

দ্বিতীয়ত: বাংলাদেশের বিরোধী মৌলবাদী শক্তিগুলোর পুনর্বাসন এবং ১৯৭১-এর গণহত্যার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিবর্গকে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে আসা হয়। বাংলাদেশের যারা বিরোধিতা করে, যারা ১৯৭১ সালে পাকিস্তানকে সমর্থন করেছিল, তারাই বাংলাদেশের মন্ত্রী হয়ে গাড়িতে বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে ক্ষমতার দাপট দেখাতে শুরু করে। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের নানান উচ্চপদে আসীন এবং বিদেশে নিরাপদে প্রতিষ্ঠিত করা হয়। 

তৃতীয়ত: পাঠ্যপুস্তকে ইতিহাসকে বিকৃত করে তরুণ প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করে বিপথগামী করার অপপ্রয়াস চালানো হয়। পাঠ্যসূচিকে ইসলামিকরণের জন্য অন্য ধর্মের কবি-লেখকদের লেখা বাদ দেওয়া হয়। বহু নিষ্পত্তিকৃত সত্যকে খুঁচিয়ে নতুন বিতর্ক সৃষ্টির চেষ্টা করা হয়, যেমন—বাংলাদেশের স্বাধীনতা কে ঘোষণা করেন, আমরা বাঙালি না বাংলাদেশি ইত্যাদি। 

চতুর্থত: দেশের মধ্যে উদারপন্থী চিন্তা-চেতনাকে নস্যাৎ করা, সেই সঙ্গে বাংলাদেশের সব রকমের সংখ্যালঘু জোটের নিপীড়ন সংহত করা হলো। রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের নাম করে আমাদের মূল্যবোধের ধর্মনিরপেক্ষতাকে নষ্ট করা হলো এবং সমাজের অসাম্প্রদায়িক কাঠামোকে আঘাত করা হলো। 

পঞ্চমত: জোটনিরপেক্ষ চরিত্র ত্যাগ করে মধ্যপ্রাচ্যের ইসলামি জেটের সঙ্গে সম্পৃক্ততা। এর একটি উদ্দেশ্য ছিল সম্পৎশালী মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে অর্থপ্রাপ্তি, অন্যদিকে এসব দেশের সঙ্গে একটি আদর্শগত সংযোগ স্থাপন। 

এসব কর্মকাণ্ডের প্রেক্ষাপটে তিনটি প্রবণতা লক্ষণীয়: এক. একসময় রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পীঠস্থান থেকে বলা হয়েছিল, ‘অর্থ কোনো সমস্যা নয়’। দৃশ্যমানতা, জবাবদিহি ও দায়বদ্ধতা নষ্ট করার এর চেয়ে আর ভালো উপকরণ হয় না। দুই. ‘আমি রাজনীতিকে রাজনীতিকদের জন্য কঠিন করে তুলব’। একটি সুস্থ রাজনৈতিক কাঠামো ধ্বংস করতে এর চেয়ে মোক্ষম অস্ত্র নেই। তিন. দলবদলের রাজনীতিতে উৎসাহিত করা হয়েছিল। এসবেরই সমন্বিত ফলাফল হচ্ছে, বাংলাদেশের অর্থনীতি, রাজনীতি ও সমাজনীতিতে সুস্থ প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোকে স্থায়ীভাবে পঙ্গু করে দেওয়া। 

এই সবকিছুর কারণে পরবর্তী সময়ে তিনটি ধারার সৃষ্টি হয়েছে স্বদেশে। এক. যারা ১৯৭১ সালে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও আদর্শিক মূল্যবোধে বিশ্বাস করেনি এবং এর বিরোধিতা করেছে, তাদের অবস্থান আরও সংহত হয়েছে। দুই. আমরা যারা একাত্তরের প্রজন্ম, তাদের একটি অংশ যেমন বাংলাদেশ নামটি, তার মুক্তিযুদ্ধ, তার আদর্শিক মূল্যবোধ দ্বারা সর্বদা সার্বক্ষণিকভাবে উদ্বেলিত হয়েছি, তেমনি আমাদের প্রজন্মের আরেকটি অংশ তো সবকিছু শুধু বিস্মৃতই হইনি, বিপথগামীও তো হয়েছি। তিন. জাতির নতুন প্রজন্মের কাছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও ইতিহাস, আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশের আদর্শিক মূল্যবোধ হয় সম্পূর্ণ অজ্ঞাত রয়ে গেছে, নয়তো বিকৃত হয়ে উপস্থাপিত হয়েছে। 

২০২৪ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫৩ বছর অতিক্রান্ত হলো। আমরা একটি ক্রান্তিকালের মাঝখান দিয়ে চলেছি। যখন ফিরে তাকাই, তখন মনে হয় ১৯৭১ সালের মতো আজও একটি সংগ্রাম আমাদের করতে হবে—সেই লড়াই বাংলাদেশের মূল্যবোধকে সংহত করার, সেই যুদ্ধ বঙ্গবন্ধুর আদর্শিক চিন্তা-চেতনাকে প্রতিষ্ঠিত করার। চূড়ান্ত বিচারে, এই লড়াই আমাদের বাঁচার লড়াই, এই লড়াইয়ে জিততে হবে। 

সেলিম জাহান, ভূতপূর্ব পরিচালক, মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন দপ্তর ও দারিদ্র্য বিমোচন বিভাগ, জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি, নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের সঙ্গে আমাদের কি বিচ্ছেদ হলো

একাত্তরে সামষ্টিক মুক্তি আসেনি

আজ বিজয়ের দিন

অসময়েই শত্রু-মিত্র, মীরজাফর ও বিশ্বাসঘাতককে চেনা যায়

খেলা কি তবে এবার মুখ ও মুখোশের

রিক্রুটিং এজেন্সির প্রতারণা

বুদ্ধিজীবী দিবস যেন ভুলে না যাই

উড়োজাহাজগুলোও পরিবেশের ক্ষতি করছে

গুলিবিদ্ধ হাদি ও নির্বাচন

নির্বাচনের পথে দেশ