হোম > মতামত > উপসম্পাদকীয়

লেখাটি নতুন দিনের তরুণদের জন্য

জাহীদ রেজা নূর  

ইতিহাসের বৈপরীত্যগুলো নিয়েই তরুণসমাজকে ভাবতে হবে

আমার এই লেখা যেদিন ছাপা হবে, সেদিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিন। ১৯৭১ সালের ১৭ মার্চ পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে দ্বিতীয় দফা বৈঠকে বসেছিলেন বঙ্গবন্ধু। মার্চ মাসের সেই দিনগুলিতে লিখিত হচ্ছিল এই ভূখণ্ডের আলোড়ন জাগানো ইতিহাস। চলছিল অসহযোগ আন্দোলন। নতুন দিনের তরুণদের জন্য সেই দিনটির কথাই এখানে বলব।

তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতেই ইতিহাস নির্মিত হয়। যারা সেই ইতিহাসকে গুবলেট করে নিজস্ব বয়ান তৈরির চেষ্টা করে, তারা আবেগের বশে বুঝতেও চায় না, ইতিহাসই কেবল ইতিহাস হয়। চাপিয়ে দেওয়া বয়ান দিয়ে মিথ্যাকে ভিত্তি দেওয়া যায় না।

যে তরুণ আগামী দিনের ইতিহাস লিখবে, তাকেই অনুরোধ করব আমার লেখার বিষয়বস্তু নিয়ে ভাবতে। এই বর্ণনায় যদি সত্যিকার আবহ ফুটে ওঠে, তাহলে তারা যেন সেই সময়কে অনুভব করার চেষ্টা করে। যারা সদম্ভে সবকিছু গুঁড়িয়ে দিয়ে নতুন মিথ্যা বয়ান তৈরি করে, সময় তাদের মিথ্যাচার প্রকাশ করে দেয়। এর প্রমাণ রয়েছে ভূরি ভূরি। এমনকি গোয়েবলসের মিথ্যাকে সত্য বানানোর যে তত্ত্বের ওপর নির্ভর করে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্নভাবে মিথ্যাচার প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করা হয়, তারও মুখোশ একসময় খুলে পড়ে। যেমন খসে পড়েছিল খোদ গোয়েবলসের গুরু হিটলারের বিকৃত মুখোশ!

২. প্রসঙ্গটি একাত্তরে সীমাবদ্ধ না রেখে আরেকটু বিস্তারে যাওয়া যাক। পলাশী ও সিরাজউদ্দৌলার কথা বলা হলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে। যাঁরা একটা বড় মাধ্যমে ক্ষমতায় আসেন, তাঁরা তাঁদের দাবির যৌক্তিকতা প্রমাণের জন্য এমন কিছু কর্মকাণ্ড করেন, যা একধরনের হিংসাত্মক আবহের জন্ম দেয়। ১৭৫৭ সালের পলাশীর যুদ্ধের আগে-পরের কিছু ঘটনায় তারই প্রকাশ দেখা গেছে।

তোষামোদি এই অঞ্চলের রাজনীতিতে নতুন নয়। যে লর্ড ক্লাইভের নেতৃত্বে পলাশীর যুদ্ধে জয়ী হয়েছিল ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি, সেই ক্লাইভকেই স্বয়ং মোগল সম্রাট কী কী উপাধি দিয়েছিলেন, সেগুলোর কথা মনে করা যেতে পারে। সাইফ জং বা সমরে তরবারি, আমিরুল মামালিক বা সাম্রাজ্যের সেরা আমির, মুইন-উদ-দৌলা বা সাম্রাজ্যের সেরা ব্যক্তিত্ব—ক্লাইভকে এই উপাধিগুলো দিয়েছিলেন দিল্লীশ্বর! কেন দিয়েছিলেন? কারণ, কেন্দ্রীয় শাসন দুর্বল হয়ে যাওয়ায় বাংলা থেকে পর্যাপ্ত রাজস্ব পাচ্ছিলেন না দিল্লির বাদশাহ। তাঁর মুরোদও ছিল না বাংলায় নিজের সৈন্যবাহিনী দিয়ে আক্রমণ করাবেন! সিরাজউদ্দৌলাকে বারবার তাগাদা দেওয়া হলেও তিনি তা আমলে নেননি। ওদিকে ব্রিটিশরা বাদশাহকে নিয়মিত কর দেওয়ার অঙ্গীকার করে সুবাহ বাংলার দেওয়ানি লাভ করেছিল।

কেন কথাগুলো বলছি? বাংলার ইতিহাসে সিরাজউদ্দৌলাকেও একদল লেখক অর্বাচীন, লম্পট, নিষ্ঠুর, বদমেজাজি হিসেবে আখ্যায়িত করে খলনায়কে পরিণত করার চেষ্টা করেছেন। কারা এই চেষ্টা করেছেন? তাঁরা কি শুধু ইংরেজ এবং উচ্চবর্ণের হিন্দু? একেবারেই না। এঁদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন মুসলিম সাহিত্যিকেরাও।

ইতিহাসের একটা সাধারণ বৈশিষ্ট্য, বিজয়ী পক্ষ পরাজিতদের চরিত্র হনন, নানা অপবাদের কালিমা লেপন করে তাদের ভাবমূর্তি মুছে ফেলার চেষ্টা করে থাকে। নানা মনগড়া কথা বলে তাকে অগ্রহণযোগ্য করে তোলার এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত থাকে সদ্য বিজয়ীরা। যেকোনো অভ্যুত্থান বা বিপ্লবেই এটা দেখা যায়। এসব প্রচারণার বড় উদ্দেশ্য হলো পরাজিতদের অগ্রহণযোগ্য প্রমাণ করা, যেন তার সমর্থকেরা কোনো আন্দোলন গড়ে তুলতে না পারে। সিরাজও এই বিকৃত প্রচারণা থেকে রেহাই পাননি।

পলাশীর যুদ্ধে বিজয়ী ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকেই ত্রাতা হিসেবে উপস্থাপন করার জন্য, কোম্পানির মাহাত্ম্য বর্ণনার জন্য ইংরেজরা নিযুক্ত করল পেশাদার লেখকদের। তাঁরাও কিছু সুযোগ-সুবিধার বিনিময়ে কোম্পানির গুণগান গাইতে লাগলেন। সিরাজের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালালেন বীরদর্পে।

কারা এই অপপ্রচার চালিয়েছিলেন? কয়েকটি নাম এখানে বলে রাখা দরকার। একজন হলেন বিখ্যাত ‘সাইর-ই-মুতাখখিরিন’-এর লেখক গোলাম হোসেন খান। একজন হলেন রিয়াজ-উস-সালাতিন’-এর লেখক গোলাম সলিম, ‘মোজাফফরনামা’র লেখক করম আলী, ‘তারিখ-ই-বাংলা মহব্ব্তজঙ্গী’র লেখক ইউসুফ আলী খান। এঁরা সবাই পলাশীর যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ের বুদ্ধিজীবী। ইংরেজদের প্ররোচনা ও পুরস্কারের আশায় তাঁরা সিরাজউদ্দৌলাকে অবমূল্যায়িত করেছেন নির্মমভাবে। তাদের চোখে সিরাজ হলেন দুর্বৃত্ত, লম্পট, কোম্পানি হলো ত্রাতা!

সিরাজের চরিত্র কলুষিত করার পরবর্তী নায়কেরা হলেন ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত নব্য ভদ্রলোক লেখকেরা। এঁদের বেশির ভাগই হিন্দু সম্প্রদায়ের। এঁদের মধ্যে স্যার যদুনাথ সরকারের নাম উল্লেখ করা যায়।

সিরাজউদ্দৌলা ধোয়া তুলসী পাতা ছিলেন না। কিন্তু তাঁর সাহসের জায়গা, সত্যের জায়গাটাকে লুকিয়ে রেখে কেবল তার নেতিবাচক চরিত্রই তুলে ধরেছিলেন কোম্পানির আর্থিক সুবিধাপ্রাপ্ত লেখকেরা।

৩. শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে মিথ্যাচার করার বিপদ অনেক। কারণ, বাংলার রাজনীতিতে বঙ্গবন্ধুর পদচারণ এতটাই নিকট-অতীতে যে, চাইলেই বঙ্গবন্ধুর অর্জনগুলোর ওপর কালিমা লেপন করা সম্ভব নয়; বিশেষ করে ১৯৬৬ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত এ দেশের রাজনীতির মধ্যমণি ছিলেন তিনি। নানা দলের বড় বড় নেতার কেউই তাঁর মতো দেশের জনগণের হৃদয়ে প্রবেশ করতে পারেননি। মওলানা ভাসানীর নিজস্ব রাজনৈতিক রীতি ছিল বটে, কিন্তু ইতিহাসের বিভিন্ন জায়গায় তাঁর রহস্যজনক আচরণের কারণে জনগণ তাঁর ওপর আস্থা রাখেনি, রেখেছে শেখ মুজিবুর রহমানের ওপর। চীনের অনুরোধে আইয়ুব খানকে বহুদিন পর্যন্ত ছাড় দেওয়া, ‘ভোটের আগে ভাত’ স্লোগান দিয়ে নির্বাচন বানচাল করার চেষ্টাসহ নানা সময়ে তাঁর নানা পদক্ষেপ দেশের মানুষকে তাঁর প্রতি অবিচল বিশ্বাস নিয়ে দাঁড়াতে দেয়নি। আওয়ামী লীগ ৬ দফার মাধ্যমে দেশের মানুষের হৃদয় ছুঁতে পেরেছিল। সে সময়কার পত্রপত্রিকার দিকে তাকালেই আমরা তা দেখতে পাব।

সিরাজউদ্দৌলার ব্যাপারে যেমন মিথ্যাচারে সয়লাব করে ফেলা হয়েছিল দেশ, শেখ মুজিবুর রহমানের ব্যাপারেও সে রকম মিথ্যাচার চালানো হয়েছে। এটা দেখা গেছে ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে যখন একদল পথভ্রষ্ট পাষণ্ড হত্যা করল, তখন। সে সময় কী ধরনের প্রচারণা চালানো হয়েছিল, এই সময়ের তরুণদের অনুরোধ করছি, সেগুলো পড়ার জন্য। এখনো যারা ১৯৭৫ সালের বিয়োগান্ত পটপরিবর্তনের ঘটনাকে মহিমান্বিত করার চেষ্টা করে, তারা ইতিহাসের প্রতি বিশ্বস্ত থাকে না। তারা পাকিস্তানপন্থী ধ্যানধারণার ক্রীড়নক ছাড়া আর কিছু নয়।

বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের অন্যায় আচরণের প্রতিবাদ করার সময় শেখ মুজিবুর রহমানের সম্মানহানি করতে হবে কেন, সেটা বোধগম্য নয়। বিশেষ করে শেখ হাসিনার ভাষণের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর বাড়ি গুঁড়িয়ে দেওয়ার যোগসূত্র কী, সেটা কেউ যৌক্তিকভাবে খুঁজে বের করতে পারবেন বলে মনে হয় না। এ সময়টিতে সরকারের নির্লিপ্ততারও ব্যাখ্যা পাওয়া কঠিন। জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে যাঁরা সক্রিয় ছিলেন, তাঁদের একটা বড় অংশ এই ধ্বংসযজ্ঞের সমর্থক ছিলেন না বলে মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে। একটি মুক্ত স্বদেশ, স্বৈরাচারবিরোধী স্বদেশ গড়ার স্বপ্ন শুধু ধ্বংসযজ্ঞ দিয়ে বাস্তবে রূপান্তর করা যায় না।

খুবই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, এ সময় যেসব আলোচনা হচ্ছে, তাতে শেখ মুজিব আর শেখ হাসিনার শাসনামলকে ফ্যাসিবাদ বলা হচ্ছে, অথচ আড়ালে রাখা হচ্ছে জিয়াউর রহমান, হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, খালেদা জিয়ার শাসনামল। এটাকেও সিরাজউদ্দৌলার সময়কার বুদ্ধিজীবীদের মতামতের মতো এই সময়ের একশ্রেণির সুবিধাভোগী বুদ্ধিজীবীর বয়ান হিসেবে তুলে ধরা হলে কি ভুল করা হবে? তার চেয়ে বড় কথা, যে জামায়াতে ইসলামী দেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় ঘাতকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল, তারা ক্ষমা না চেয়েও এ দেশে রাজনীতি করতে পারছে। জামায়াতের একাত্তরের কাণ্ডকীর্তি নিয়ে কোনো প্রশ্ন করা হচ্ছে না। জামায়াত তাদের ইচ্ছেমতো একাত্তরকে পুনর্নির্মাণ করতে চাইছে। একাত্তরের পত্রপত্রিকাতেই এই ঘাতকদের আসল চেহারা প্রকাশিত হয়েছে, সেদিকেও তরুণেরা দৃষ্টি রাখবে বলে আমার বিশ্বাস।

এই বৈপরীত্যগুলো নিয়েই তরুণসমাজকে ভাবতে হবে। রাজনীতির মাঠে যার যে ভুল আছে, অন্যায় আছে, তা নিয়ে স্বচ্ছ আলাপ-আলোচনা হতে হবে। নইলে একই ধরনের স্বৈরাচারী ভাবনাকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে।

৪. ১৯৭১ সালের ১৭ মার্চ এই ঢাকা মহানগরীতে কী কী ঘটনা ঘটেছিল, তারই কিছু আজ আলোচনা করি।

সাংবাদিকেরা বঙ্গবন্ধুকে তাঁর জন্মদিন নিয়ে প্রশ্ন করলে তিনি বলেছিলেন, জনগণের সার্বিক মুক্তিই তাঁর জন্মদিনের সবচেয়ে বড় ও পবিত্র কামনা।

সেদিন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সঙ্গে বৈঠকের পর বঙ্গবন্ধু নিজ বাড়িতে পৌঁছালে সাংবাদিকেরা যখন জন্মদিন নিয়ে প্রশ্ন করেন, তখন বঙ্গবন্ধু বেদনার্ত হয়ে বলেন, ‘আমি জন্মদিন পালন করি না, আমার জন্মদিনে মোমের বাতি জ্বালি না, কেকও কাটি না। এ দেশে মানুষের নিরাপত্তা নাই। অন্যের খেয়ালে যেকোনো মুহূর্তে তাদের মৃত্যু হতে পারে। আমি জনগণেরই একজন। আমার জন্মদিনই কী, আর মৃত্যুদিনই কী?

সকালে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সঙ্গে এক ঘণ্টাব্যাপী আলোচনা হয়। আলোচনা শেষে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আলোচনা শেষ হয়নি। পরবর্তী বৈঠকের সময় ঠিক হয়নি। আজও হতে পারে, কালও হতে পারে। লক্ষ্য অর্জন না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে।

আজকের বৈঠক এত সংক্ষিপ্ত হলো কেন—এ রকম একটি প্রশ্নের জবাবে বঙ্গবন্ধু মৃদু হেসে তার জবাব দেন। তখন একজন বিদেশি সাংবাদিক বলেন, ‘আপনার এই হাসি থেকে কি কিছু অনুমান করে নিতে পারি?’

বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমি জাহান্নামে বসেও হাসতে পারি।’

বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে তাঁকে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হয়, ‘বঙ্গবন্ধু, আপনি কি হাসছেন?’

লেখক: উপসম্পাদক, আজকের পত্রিকা

এক সাধারণ সন্ধ্যার গল্প

নারী ও কন্যাশিশুকে মনস্তাত্ত্বিকভাবে ক্ষমতাহীন ভাবা হয়

সংলাপ, সংস্কার ও রাজনৈতিক ঐকমত্য

ভারতের দুমুখো নীতিই সম্পর্কোন্নয়নের অন্তরায়

নির্বাচন নিয়ে সংশয় কেন

আমরা কি শুধু মৃত্যুর অপেক্ষায় থাকব

এনআইডি নিয়ে নতুন প্রতিষ্ঠান নতুন বিতর্ক তৈরি করবে

ধর্ষণ প্রতিরোধে রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব

শব্দের আড়ালে গল্প: ফ্যাঁকড়া

দেশের হৃৎপিণ্ডে প্রচণ্ড ধাক্কা দিয়ে গেল মেয়েটি