হোম > মতামত > উপসম্পাদকীয়

ফিরবে না আর পৃথিবীর যৌবন

মাসুদ–উর রহমান

আজ থেকে প্রায় ১৩.৭ বিলিয়ন বছর আগে একটা মটরদানার মতো ক্ষুদ্র বস্তুর বিস্ফোরণের ফলে জন্ম হয়েছিল আমাদের এই মহাবিশ্বের। যাকে বলা হয়ে থাকে ‘বিগ ব্যাঙ’ বিস্ফোরণ। এই বিগ ব্যাঙের ফলেই জন্ম হয়েছে মহাবিশ্ব এবং আমাদের পৃথিবীর। এরই ধারাবাহিকতায় নানা ধরনের রাসায়নিক বিক্রিয়ার ফলে ধীরে ধীরে এখানে উদ্ভব ঘটেছে জীবের, মানুষের।

সৃষ্টির শুরুতে পৃথিবী অতি উত্তপ্ত ছিল। আমাদের সৌরজগতের একমাত্র নক্ষত্র যেমন উত্তপ্ত, তেমনি উত্তপ্ত ছিল। তারপর ধীরে ধীরে লাখ লাখ বছর সময় নিয়ে এটি ঠান্ডা হয়। অতঃপর নানা রাসায়নিক বিক্রিয়ার ফলে জীবের জন্ম হয়েছে এই পৃথিবীতে। মানুষের সঙ্গে অনেক দিক দিয়েই মিল রয়েছে আমাদের এই ধরণির। মানুষ একসময় জন্মগ্রহণ করে, তারপর একদিন এই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে মৃত্যুবরণ করে। পৃথিবীরও জন্ম হয়েছে, সেটিও একদিন ধ্বংস হয়ে যাবে।

একটা মানবশিশু জন্মের পর তার মধ্যে বোধ-বুদ্ধি কিছুই থাকে না। সে তার চারদিকের পরিবেশে কী ঘটছে না ঘটছে তার কোনো কিছু সম্পর্কেই অবহিত থাকে না। সে শুধু জানে কান্না করতে, খাদ্য গ্রহণ করতে ও প্রাকৃতিক কাযার্দি সম্পন্ন করতে। যেসব কিনা তার অজান্তেই ঘটে। ধীরে ধীরে যখন তার বয়স বাড়ে, সে তার আশপাশের মানুষজনের সঙ্গে মেশে, তখন একজন সামাজিক মানুষে পরিণত হয়। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তার মধ্যে পরিপক্বতা আসে। আমাদের এই পৃথিবীটারও যখন প্রথম জন্ম হয়েছিল, তখন সে ছিল অপরিপক্ব। ধীরে ধীরে যখন গরম অবস্থা থেকে ঠান্ডা হয়, তখন তার মধ্যে কিছুটা পরিপক্বতা আসে। তার মধ্যে জীব বসবাসের উপযোগী পরিবেশ তৈরি হতে থাকে। তার অভ্যন্তরে সৃষ্টি হয় জীবনের অপর নাম পানি।

আমাদের পৃথিবীটা যখন শিশু ছিল, তখন তার মধ্যে জীবের অস্তিত্ব ছিল না। সে নিজেকে পরিপক্ব করে জীবের জন্ম দিয়েছে। একজন মা যখন সন্তান জন্ম দেয় তখন মাকে আগে পরিপক্ব হতে হয়। তা না হলে অনাগত সন্তানের প্রাণনাশের আশঙ্কা থাকে। পৃথিবীর ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি।

আবার, একটা মানুষ জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই সবকিছু শিখে যায় না। সে শেখে তার আশপাশের জগৎ থেকে। ঠিক তেমনিভাবে ধরিত্রীতে যখন জীবের উদ্ভব ঘটে, তখনই তারা সবকিছু শিখে যায়নি। ধীরে ধীরে তার আশপাশের জগৎ থেকে জ্ঞান আহরণ করেছে। প্রকৃতি থেকে শিখতে শিখতে এবং প্রকৃতির সঙ্গে সংগ্রাম করে মানুষ সভ্য হয়েছে।

মধ্যযুগটাকে পৃথিবীর যৌবনকাল বলা যেতে পারে। এই যুগে শিল্প-সাহিত্য, সংস্কৃতি, সভ্যতা, জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রসার ঘটেছে। সেই যুগটাই ছিল পৃথিবীর স্বর্ণযুগ। তখন মানুষের মধ্যে হিংসা-প্রতিহিংসা, লোভ-লালসা, স্বার্থপরতা ছিল না। ছিল না কোনো দুর্নীতির মনোভাব। যদিও কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমরা তার ব্যতিক্রম দেখেছি। যেমন রাজারা তাদের সৈন্যসামন্ত নিয়ে যখন রাজ্য দখলে যেত, তখন হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু হতো। তবে আমি এখানে রাজাদের আনতে চাই না, আমি বলছি সাধারণ মানুষের কথা। সে সময়কার পৃথিবীটা ছিল মানসিক ব্যাধিমুক্ত।

কিন্তু এই আধুনিক যুগে এসে পৃথিবী তার যৌবন হারিয়ে ইতিমধ্যে বার্ধক্যের ধাপে এক পা দিয়ে দিয়েছে। জ্ঞান-বিজ্ঞানের অভাবনীয় উৎকর্ষের ফলে একদিকে যেমন মানুষের জীবন কিছুটা সহজ হয়েছে, আরেক দিকে পৃথিবীর জীবন অনেকটা দুর্বিষহ হয়েছে। মানুষ এখন পৃথিবী নিয়ে যে গবেষণা করছে তাকে বলা যেতে পারে ধরণির প্রিমর্টেম। পৃথিবীর মৃত্যুর পর পোস্টমর্টেমের সুযোগ নেই বলে আগেভাগেই প্রিমর্টেম করছে!

জীবন সহজ করতে কয়লা পুড়িয়ে মানুষ বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে। যাতায়াত সহজ করতে নানা যানবাহনে ব্যবহৃত হচ্ছে পেট্রোল, ডিজেল ইত্যাদি হাইড্রোকার্বন। যেগুলো বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইড, মিথেনসহ নানা গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ করছে। বায়ুমণ্ডলের ওজোন স্তরে এসব গ্রিনহাউস গ্যাস জমা হয়ে যে সমস্যা তৈরি করছে তার নাম বৈশ্বিক উষ্ণায়ন (গ্লোবাল ওয়ার্মিং)। আবার বিভিন্ন তেজস্ক্রিয় বিকিরণের কারণে মানুষের মধ্যে ক্যানসার, টিউমারসহ নানা রোগের জন্ম হয়েছে। তামাক, নেশাদ্রব্য আবিষ্কারের কারণে পৃথিবীর অনেক মানুষ এখন নেশাগ্রস্ত। সমাজের একটা বৃহৎ জনশক্তি এখন মাদকাসক্ত। মোবাইল ফোন নামক প্রয়োজনীয় উপদ্রবটি আবিষ্কারের কারণে মানুষ এখন ভুলে গিয়েছে যে তার আশপাশেও একটি জগৎ আছে। সে এখন মোবাইলের জগৎ ছাড়া আর কিছুই বোঝে না। তার উদাহরণ আমরা কিছুদিন আগে দেখেছি। কোটা-সংস্কার আন্দোলনের সময় ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়ায় মানুষ ১০টা দিন পাগলপ্রায় জীবন যাপন করেছে। হাহাকার করেছে নেটওয়ার্কের জন্য। কারণ ইন্টারনেট ছাড়া যে মোবাইল ফোন প্রায় অচল!

আধুনিক যুগে এসে পৃথিবী সম্মুখীন হয়েছে কোভিড-১৯ নামের ভয়াবহ মহামারির। মাঝে ছড়িয়েছে মাঙ্কিপক্স নামক আরেক মহামারি। কিছুদিন আগে গণমাধ্যমে উঠে এসেছিল জম্বি ভাইরাসের কথা। এগুলো বাদেও যে কত কোটি রোগ পৃথিবীতে আছে তা গণনা করে শেষ করা যাবে না। এত শত রোগে পৃথিবী আক্রান্ত হচ্ছে। এই রোগের ওষুধ তৈরি করতে গিয়ে দূষিত হচ্ছে পরিবেশ, দূষিত হচ্ছে পৃথিবী।

বর্তমানে পৃথিবী যে সবচেয়ে ভয়াবহ সমস্যার মুখোমুখি, সেটি হচ্ছে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন এবং তেজস্ক্রিয়তা। যেটা এখন একটা অভিশাপের মতো। কতিপয় বিশ্বনেতা অবশ্য এই সমস্যা থেকে সমাধানের জন্য অনেক পদক্ষেপ হাতে নিয়েছে, তবে অধিকাংশই এই ব্যাপারে উদাসীন। কিন্তু মানুষ এখন যে যান্ত্রিক জীবন যাপন করছে, এই জীবন যাপন থেকে বের হয়ে এসে তাদের মাতা পৃথিবীর জন্য ভাবার সময় যেন তাদের হাতে নেই। তারা নিজ স্বার্থ চরিতার্থের লক্ষ্যে যেকোনো খারাপ কাজের সঙ্গে জড়াতে দুইবার ভাবে না। এখন মানুষের বেঁচে থাকার মন্ত্র একটাই—‘যার যেটা হওয়ার হোক, আমি ভালো থাকলেই হলো!’

বর্তমানের এই বৈশ্বিক উষ্ণায়নের প্রধান কারণ হিসেবে জনসংখ্যাকে দায়ী করা যায়। জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে মানুষ বসবাসের জন্য বনভূমি উজাড় করে বাড়িঘর তৈরি করছে। বনভূমি উজাড় করার কারণে অধিক পরিমাণ কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্রহণ করার জন্য প্রয়োজনীয় গাছপালা নেই। তাই অতিরিক্ত কার্বন ডাই-অক্সাইড ওজোন স্তরে চলে যাচ্ছে।

এত হাজার সমস্যা, হাজার ব্যাধি বার্ধক্যকেই নির্দেশ করে। মানুষ বার্ধক্যে উপনীত হলে তার শরীরে নানা রোগ-ব্যাধি জন্ম নিতে থাকে। পৃথিবীর ক্ষেত্রেও তার কোনো ব্যতিক্রম হবে না। সেও বৃদ্ধ হতে হতে একদিন মারা যাবে তথা ধ্বংস হয়ে যাবে। ইতিমধ্যে পৃথিবীর যে ক্ষতিসাধন হয়েছে তা অপূরণীয়। তাই আমরা চাইলেও আমাদের পৃথিবীকে আর যৌবনে ফেরত নিয়ে যেতে পারব না, কিন্তু চাইলেই আমরা যান্ত্রিক জীবন থেকে বেরিয়ে এসে আমাদের বাসভূমি পৃথিবীটাকে আরও বেশি দিন বাঁচিয়ে রাখতে পারব। এ জন্য দরকার সকল প্রকার দূষণ-রেডিয়েশন কমানো এবং জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ। সবোর্পরি, যান্ত্রিক জীবন থেকে একটু বের হয়ে এসে সব মানুষের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব-সৌহার্দ্যপূর্ণ, প্রেম-প্রীতি ও ভালোবাসার সম্পর্ক বজায় রাখা তথা সবাইকে নিয়ে খুশি থাকা। কারণ সন্তানের খুশি দেখলেই মা ভালো থাকবে।

লেখক: মাসুদ উর রহমান

কলেজশিক্ষক ও সংস্কৃতিকর্মী

এবার নির্বাচনের দিকে চোখ থাকবে সবার

আন্তর্জাতিক মূল্যহ্রাস ভোক্তার কাছে পৌঁছায় না কেন

ভারতজুড়েই কি ফুটবে পদ্মফুল

ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ

সমুদ্রস্তরের উত্থান ও দ্বীপরাষ্ট্রের নিরাপত্তা

সংকটেও ভালো থাকুক বাংলাদেশ

মন্ত্রীদের বেতন-ভাতা নিয়ে কথা

পাঠকের লেখা: বিজয় অর্জনের গৌরব

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের সঙ্গে আমাদের কি বিচ্ছেদ হলো

একাত্তরে সামষ্টিক মুক্তি আসেনি