হোম > মতামত > উপসম্পাদকীয়

মানুষ ঠকাতে চারপাশে প্রতারণার জাল

ফারুক মেহেদী

তিনি স্কুলের গণ্ডি পার হননি। অথচ চড়েন ৫ কোটি টাকার গাড়িতে। সঙ্গে ওয়াকিটকিসহ সার্বক্ষণিক দেহরক্ষী। গুলশান ১ নম্বর সেকশনের জব্বার টাওয়ারে মাসিক ৫ লাখ টাকা ভাড়ায় আলিশান অফিস। তাঁর সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতের নজরানা ১ লাখ টাকা! ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় নামে-বেনামে ফ্ল্যাট। গাজীপুরে বাগানবাড়ি। নাম তাঁর আবদুল কাদের। সরকারের অতিরিক্ত সচিব! না না, বাস্তবে নয়; মানুষ ঠকানোর জন্য এটা তাঁর প্রতারণার কৌশল। এভাবে তিনি ১৪ বছর ধরে প্রতারণা করে কোটি কোটি টাকার মালিক। গণমাধ্যমে এ রকমই একটি খবর পড়লাম দুদিন আগে। ধরা পড়ার পর এখন তিনি জেলখানায়।
আরেকটি ঘটনা। এস-ফ্যাক্টর, সর্বরোগের মহৌষধ! ক্যানসার, ডায়াবেটিস বা হার্টের ওষুধই শুধু নয়, করোনা প্রতিরোধেও কার্যকর—এমন প্রচারণা চালিয়ে পার্সেন্টেজ ও প্যাকেজের ফাঁদে ফেলে লাখো গ্রাহকের কাছ থেকে ২৫ কোটির বেশি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে ‘সুইসডার্ম’ নামের ভুঁইফোড় এক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে। এ খবরটিও গণমাধ্যমে এসেছে। সিরাজগঞ্জে ‘সিরাজগঞ্জশপ ডটকম’ ও ‘আলাদিনের প্রদীপ’ নামের দুটি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান খুলে রাতারাতি আলাদিনের চেরাগ হাতে পেয়ে যান স্থানীয় কয়েক যুবক। চটকদার বিজ্ঞাপন ও বিশাল ছাড়ের অফারের ফাঁদে ফেলে হাজার হাজার গ্রাহকের প্রায় ২২ কোটি টাকা নিয়ে গা ঢাকা দিয়েছেন তাঁরা।

আরেকটি খবর চোখে পড়ল কয়েক দিন আগে। এক প্রতিষ্ঠান চীন থেকে সুদের ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জামানতবিহীন ঋণের চটকদার বিজ্ঞাপন দিয়ে মানুষকে প্রলুব্ধ করে তারা। এ জন্য নির্দিষ্ট একটি অ্যাপের মাধ্যমে ঋণ দেওয়ার নামে চড়া সুদ নিয়ে প্রতারণা করে এ চক্রটি। তাঁদের কয়েক সদস্যও সম্প্রতি ধরা পড়েছেন।

এগুলোর পাশাপাশি কিছুদিন ধরে তো পত্রিকার পাতা আর টিভির পর্দা ই-কমার্সের নামে প্রতারণার খবরে সয়লাব। এই রেশ এখনো কাটেনি। প্রতিদিনই এটি বড় খবর। এসব খবর থেকে যেটুকু জানলাম, তাতে দেখা যায়, ই-কমার্স ও সমবায় সমিতির নামে গ্রাহকের কাছ থেকে এ পর্যন্ত অন্তত ৩০ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে। অর্ধেক দামে পণ্য দেওয়ার নামে সহস্রাধিক ক্রেতার কাছ থেকে ২৫ হাজার কোটি টাকা সংগ্রহ করেছে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো। ধর্মের নামে ১৭ হাজার কোটি টাকা নিয়েছে এহসান গ্রুপ। রাজধানী থেকে প্রত্যন্ত গ্রামে বিভিন্ন সমবায় সমিতির নামে দ্বিগুণ মুনাফার কথা বলে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা গ্রাহকের কাছ থেকে নেওয়া হয়েছে। অনেক সমবায় সমিতি গ্রাহকের টাকা নিয়ে উধাও হয়েছে।

খবরে আরও জানা যায়, প্রতারণা ও মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগ উঠেছে ইভ্যালি, ই-অরেঞ্জ, ধামাকা শপিং, কিউকম, এসপিসি ওয়ার্ল্ড, বুমবুম, আদিয়ান মার্ট, নিডস, দালাল, সিরাজগঞ্জশপ, নিরাপদ ডটকম, আলাদিনের প্রদীপ, এসকে ট্রেডার্স ও মোটরস, ২৪ টিকেট ডটকম, গ্রিনবাংলা, এক্সিলেন্ট বিগবাজার, ফাল্গুনিশপসহ প্রায় ২৬টি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে। ই-অরেঞ্জের গ্রাহক ও সরবরাহকারীদের ১ হাজার ১০০ কোটি, ইভ্যালি ১ হাজার কোটি, ধামাকা ৮০৩ কোটি, এসপিসি ওয়ার্ল্ড ১৫০ কোটি, নিরাপদ ডটকম ৮ কোটি, চলন্তিকা ৩১ কোটি, সুপম প্রোডাক্ট ৫০ কোটি, রূপসা মাল্টিপারপাস ২০ কোটি, নিউ নাভানা ৩০ কোটি এবং কিউ ওয়ার্ল্ড মার্কেটিং গ্রাহকদের ১৫ কোটি টাকা লোপাট করার খবর বিভিন্ন সূত্রে এরই মধ্যে প্রকাশ পেয়েছে।

এসব বড় বড় প্রতিষ্ঠানের বাইরেও দেশব্যাপী এ রকম কয়েক হাজার ছোট প্রতিষ্ঠান ফেসবুক, ইউটিউব এবং নিজস্ব অ্যাপস, ওয়েবসাইট খুলেও অব্যাহতভাবে প্রতারণা চালিয়ে যাচ্ছে। মানুষ এখনো যুবক, ডেসটিনি, ইউনিপে টু ইউর কথা ভুলে যায়নি। ২০০৬ সালে যুবক ২ হাজার ৬০০ কোটি, ২০১১ সালে ইউনিপে টু ইউ ৬ হাজার কোটি আর ২০১২ সালে ডেসটিনি ৫ হাজার কোটি টাকা প্রতারণা করে লোপাট করে। গ্রাহকেরা এখনো এ টাকা ফিরে পাননি।

সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়ারনেস ফাউন্ডেশনের (সিসিএ) ‘সাইবার ক্রাইম ট্রেন্ড ইন বাংলাদেশ ২০২০’ শীর্ষক গবেষণা বলছে, গত বছর সারা দেশে যত ধরনের সাইবার অপরাধ হয়েছে, তার মধ্যে ১১ দশমিক ৪৯ শতাংশই অনলাইনে পণ্য কিনতে গিয়ে প্রতারণার ঘটনা। প্রতারিত হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৯ দশমিক ৮৫ শতাংশের বয়স ১৮ থেকে ৩০ বছর। আর দশমিক ৯২ শতাংশের বয়স ১৮ বছরের কম। গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা গেছে, পুরুষেরাই অনলাইন কেনাকাটায় বেশি প্রতারণার শিকার হয়েছেন। প্রতারিতদের মধ্যে পুরুষ ৭ দশমিক ৩৮ আর নারী ৩ দশমিক ৬৯ শতাংশ।

তথ্য বলছে, ২০২০ সালে বাংলাদেশে ই-কমার্স বাজারের আকার ১৬৬ শতাংশ বেড়েছে। বর্তমানে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকার বাজার রয়েছে এ খাতে। ২০২৩ সালের মধ্যে দেশের ই-কমার্স খাত ২৫ হাজার কোটি টাকার ওপরে পৌঁছাবে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। তবে এ খাতের মোট উদ্যোক্তার মাত্র ৭ থেকে ৮ শতাংশ ব্যবসায়িকভাবে সফল হয়েছেন। মূলত করোনাকালে মানুষের চলাচল সীমিত হওয়ায় ই-কমার্সের প্রসার ঘটে। আর এ সুযোগ নেয় প্রতারক গোষ্ঠী। বাংলাদেশে ২ হাজারের বেশি ওয়েবসাইটভিত্তিক এবং প্রায় ১ লাখের মতো ফেসবুকভিত্তিক ই-কমার্স সাইট চালু রয়েছে। কে জানে এদেরও কেউ কেউ প্রতারণার নতুন ভার্সন নিয়ে সাধারণ মানুষকে ঠকানোর কৌশলে এগোচ্ছে কি না।

এটা নাহয় ঠিক যে, সাধারণ মানুষ; যাঁদের অনেকেরই ঠিকমতো জানাশোনা নেই, দেশ-বিদেশে খোঁজখবর রাখেন না, পর্যাপ্ত জ্ঞানও নেই; তাই তাঁরা ভুল করেছেন। কিন্তু সরকার বা এর বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, দপ্তর, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, তারা তো দায়িত্বশীল। তারা তো নিয়ন্ত্রক। তাহলে তাদের কী কোনো দায় নেই? তারা কি নিজেদের দায়িত্ব পালন করেছে ঠিকমতো? একটি দেশে শূন্য থেকে একটি প্রতিষ্ঠান রাতারাতি গজিয়ে উঠল, পত্রিকায়, টিভিতে, গণমাধ্যমে চটকদার প্রচার-প্রোপাগান্ডা করল, দিনের পর দিন বিজ্ঞাপন দিল, অথচ মানুষ ঠকানোর পর জানা গেল তারা যা করেছে অবৈধ, অনিয়ম। তাহলে এখন কেন এসব বলছে? এত দিন কেন ধরল না?

ই-কমার্স কেলেঙ্কারির সবকিছুই হয়েছে প্রকাশ্যে, ডিজিটাল মাধ্যমে। প্রতিষ্ঠানগুলো ওয়েবসাইট খুলে গ্রাহককে বিশাল ছাড়ে পণ্য দেওয়ার লোভ দেখিয়েছে। বিপুল টাকা তুলেছে। লেনদেন করেছে ব্যাংক ও মোবাইল ফোনে আর্থিক সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। সরকারের দপ্তরগুলো যথাসময়ে হস্তক্ষেপ করতে পারেনি। অথচ এ প্রশ্ন যখন করা হচ্ছে, তখন কোটি কোটি টাকা হারিয়ে লাখো মানুষ পাগলপ্রায় অবস্থায়। বাণিজ্যমন্ত্রী বলছেন, গ্রাহকেরা যখন ই-কমার্স থেকে পণ্য কেনেন, তখন সরকারকে তা জানাননি। এটা কী জানানোর বিষয়? গ্রাহক কীভাবে জানাবেন? তাঁরা তো দেখেছেন দেশের জনপ্রিয়, বিখ্যাত সব সেলিব্রিটি ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর হয়ে প্রচার করছেন, মানুষকে প্রলুব্ধ করছেন। তাঁদেরও কী দায় নেই? এখন সবাই গ্রাহকের ওপর দায় চাপাচ্ছেন। একটি দেশে এত এত ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান প্রকাশ্যে সব করল, সরকার ধরল না। আর এখন বলা হচ্ছে দায় নেবে না। এর জন্য কি আগে থেকে নীতিমালা হতে পারত না?
আমরা জানি, বিভিন্ন সময়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়; বিশেষ করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে বলা হয়েছিল, ই-কমার্সের ব্যাপারে একটা নীতিমালা করার জন্য। কিন্তু কোনো আইন কিংবা নীতিমালা করা হয়নি। এখন বলা হচ্ছে, প্রতারণা ও অর্থ লোপাট ঠেকাতে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের জন্য পৃথক আইন হচ্ছে। ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। টাকা, সহায়-সম্বল হারানো লাখো অসহায় মানুষ এখন নিঃস্ব হয়ে পথে পথে ঘুরছেন। কিন্তু ইতিহাস বলে তাঁদের এ টাকা তাঁরা কবে পাবেন বা আদৌ পাবেন কি না, তার কোনো ভরসা নেই।

কোনো কিছু নিয়ে শোরগোল শুরু হলেই সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান নড়েচড়ে বসে। আগে তাদের খবর থাকে না। মানুষ যখন সব খুইয়ে পথে বসে, তখন একে-তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। মামলা হয়, প্রতিষ্ঠান বন্ধ করা হয়। এ কাজগুলো আগেই করা যায়, যদি সংস্থাগুলো ঠিকমতো কাজ করে। এই সংস্কৃতির অবসান হওয়া উচিত। ই-কমার্স থাকবে, থাকতে হবে। তবে একে শৃঙ্খলার মধ্যে আনতে হবে। মানুষকে সচেতন করাসহ যাবতীয় দায়ও সরকারকেই নিতে হবে।

এবার নির্বাচনের দিকে চোখ থাকবে সবার

আন্তর্জাতিক মূল্যহ্রাস ভোক্তার কাছে পৌঁছায় না কেন

ভারতজুড়েই কি ফুটবে পদ্মফুল

ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ

সমুদ্রস্তরের উত্থান ও দ্বীপরাষ্ট্রের নিরাপত্তা

সংকটেও ভালো থাকুক বাংলাদেশ

মন্ত্রীদের বেতন-ভাতা নিয়ে কথা

পাঠকের লেখা: বিজয় অর্জনের গৌরব

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের সঙ্গে আমাদের কি বিচ্ছেদ হলো

একাত্তরে সামষ্টিক মুক্তি আসেনি